বাল্যবিয়ের শিকার বৃষ্টি এখন হাঁটতে পারে না, প্রয়োজন সুচিকিৎসা
মাটির রাস্তার ধারেই একটি টিনের চালার ঘর। ঘরের বারান্দায় বৃষ্টি খাতুন বসে আছেন। বারান্দার সামনের ছোট্ট উঠানে তার মাও বসা। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই বৃষ্টির মা বাচা খাতুন বসতে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গত সোমবার সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দেশিগ্রামে বৃষ্টি ও তার মাকে এভাবেই দেখা গেল।
বৃষ্টিই বাচা খাতুনের একমাত্র মেয়ে। ছয় বছর বয়সে বৃষ্টির বাবা মারা যান। তখন থেকেই কোলে-পিঠে করে বড় করছেন মা। বাবাহারা মেয়েকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তাও কম নয়। নিজের হাঁস-মুরগি পালন আর কিছু কাজ করে মেয়েকে নিয়েই তার সংসার।
বাড়ির উঠানেই বৃষ্টির মা বাচা খাতুনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের বাপ-ভাই নাই। দেড় বছর আগে মেয়ের বিয়ে হয়। ছোট মেয়েটাকে (বৃষ্টি) বিয়ে দিয়ে তো আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমার মেয়ে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কীটনাশক পান করে। এখন সে খুঁত (আহত) হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। পায়ের রগে সমস্যা হওয়ায় ঠিকভাবে হাঁটতেও পারে না। মেয়েটাকে এভাবে আর দেখতে পারছি না। আর জামাই দুই মাস আগে আরেকটা বিয়ে করে ঘর-সংসার করছে।’
বৃষ্টির মা আরও বলেন, ‘জামাইয়ের পরিবার বলে যে, বিয়ে হয়নি, বিয়ের কোনো ডকুমেন্ট (কাবিন) নাই। এখন আপনারাই আমার মেয়ের জন্য কিছু একটা করেন। আমার মেয়েকে নিয়ে বিচার পাচ্ছি না, দ্বারে দ্বারে ঘুরছি! আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার একমাত্র মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আমি আর ওষুধ-চিকিৎসা করতে পারছি না।’
দেশিগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা ও বাচা খাতুনের প্রতিবেশীরা বলেন, বৃষ্টিকে বিয়ে করে তার স্বামী বাড়িতে নিয়ে যায়নি। পরে পাঁচদিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও মেয়ের স্বামী ও শ্বশুর যৌতুকের টাকার জন্য চাপ দেয়। বৃষ্টি বাড়িতে চলে এলে এখানেও তার স্বামী মমিন এসে নির্যাতন করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ঘরে থাকা কীটনাশক পান করে আত্মহ্যার চেষ্টা করে। অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে প্রথমে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। এখন মেয়েটা ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না। কীটনাশকের প্রভাবেই নাকি মেয়েটির পায়ের রগে সমস্যা হয়েছে।
দেশিগ্রাম সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টির এখনও ১৮ বছর হয়নি। বিয়ের সময় বৃষ্টি সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। গ্রামের মুন্সিকে দিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ের কোনো কাবিননামাও নেই। বৃষ্টি কীটনাশক পান করে অসুস্থ হলে চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্রে স্বামীর পরিচয়ের জায়গায় মমিনের নাম লেখা আছে।
বৃষ্টি একমাত্র মেয়ে হওয়ায় বরপক্ষ থেকে বিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। বরের বাবা বলেছিলেন, ছোট মেয়ে বিয়ে হোক, কিছুদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি বিয়ের পর স্বামী-সংসারের প্রতি স্বাভাবিক হতে পারেনি। পরে রাগ-অভিমান থেকে মায়ের ঘরে থাকা কীটনাশক পান করেন।
এদিকে বৃষ্টির স্বামী মমিন আবার যে বিয়েটি করেছেন সেটিও বাল্যবিয়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে বিয়ের বিষয়টি দেশিগ্রাম ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম জানেন বলে জানা গেছে। মমিনের পরের বিয়ের কাবিনের কাগজ আছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তার মা সদুত্তর দিতে পারেননি। বলেন, ‘কাবিনের কাগজ আছে কিনা আমি জানি না।’
বৃষ্টির মামাতো ভাই সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘যৌতুকের টাকার জন্য বৃষ্টিকে নির্যাতন করা হতো। বৃষ্টির বাড়িতে এসে যেদিন নির্যাতন করে সেদিন কীটনাশক পান করে। স্বামীর পরিবার বলছে, বিয়ের কাবিনই তো হয়নি। তারা এখন অস্বীকার করছে। কিন্তু আমাদের দাবি, যেহেতু আমাদের বোনকে বিয়ে করছে তারা এখন ভরণ-পোষণ দেবে, সংসারে নিয়ে যাবে। এ জন্য আমরা স্থানীয় মেম্বার, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ সবার কাছে এ ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
বৃষ্টির স্বামী মমিনের খোঁজে বাড়িতে গেলে তার দেখা পাওয়া যায়নি। সেখানে মমিনের মা, দুলাভাই, বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও চাচাতো ভাই সুমন সরকারের সঙ্গে কথা হয়। মমিনের মা, মামা ও ভাইয়ের স্ত্রী বলেন, মমিন আগে বিয়ে করেনি। মাত্র দেড়-দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছে। তারা (বৃষ্টির পরিবার) বিয়ের যে অভিযোগ করেছে তা মিথ্যা।
বৃষ্টি কখনো মমিনের বাড়িতেও আসেনি বলে মমিনের পরিবার থেকে দাবি করা হয়। এ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মমিনের মা ও ভাইয়ের স্ত্রীর কথাকাটাকাটি শুরু হয়। একপর্যায়ে মমিনের মা বলেন, ‘ওই মেয়ের মা মেয়েকে বলেছে তুই বিষ খা।’
কাবিন ছাড়া বিয়ের অভিযোগের বিষয়ে মমিনের চাচাতো ভাই সুমন সরকার বলেন, ‘মেয়ের মা ছেলের বাবার অর্থ-সম্পত্তি দেখে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু মেয়েই তো রাজি ছিল না। মেয়ের মা নিজেই গোপনে কীভাবে বিয়ে দিয়েছে কেউ জানে না। ১৫-২০ দিন পর শোনো যায়, ওদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট নেই। ছেলেকে একদিন মেয়ের দাওয়াত দেয়। সেদিনই শুনি মেয়েটা বিষপান করে। কিন্তু মেয়েটারই ইচ্ছে ছিল না বিয়ে করার।
দেশিগ্রামের ওই ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে এ ধরনের বাল্যবিয়ের বিষয়ে আমাদের জানানো হয় না। কেননা আমরা যদি বন্ধ করে দিই। বিয়ে হওয়ার পর আমরা শুনতে পারি। বৃষ্টি নামের মেয়েটার সঙ্গে মমিনের বিয়ে হয়েছিল শুনতে পারি যখন মেয়েটা বিষপান করে চিকিৎসাধীন ছিল।’
মমিন যে আবার বিয়ে করেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মমিনের যে আবার বিয়ে হয়েছে সেটাও আমি লোকমুখে শুনেছি।’
সুস্থভাবে হাঁটতে চাওয়ার আকুতি জানিয়ে বৃষ্টি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার স্বামী-শ্বশুর সবাই আমার ওপর অত্যাচার করছে, মারধর করছে সে জন্য আমি বিষ খাইছি। আমি এখন হাঁটতে পারি না, তারা (মমিন) বিয়ে করছে এ জন্য আমি বিচার চাই। আমার চিকিৎসার জন্যও খরচ চাই।’
এওয়াইএইচ/বিএ/জেআইএম