জিডি ও ফেসবুকে আতঙ্কের কথা লিখেছিলেন টুটুল
জীবননাশের হুমকি-ধমকির কথা জানিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। জঙ্গিদের বীভৎস সব হামলায় মৃত্যু আতঙ্কের কথা লিখেও রক্ষা পাননি প্রকাশনী সংস্থা শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল। শেষে হামলার শিকার হতেই হলো তাকে। তবে পুলিশের দাবি, থানায় জিডি হওয়ার বিষয়টি বেমালুম তারা জানেন না। ফেসবুকের বিষয়টা তো আরো দূরের কথা।
লালমাটিয়াস্থ সি ব্লকের ৮/১৩ নং পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের চারতলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়। শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ের পাঁচজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আহত শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, তারেক রহিম ও রনদীপম বসু, ওয়াশিকুর ও রাসেল নামে পাঁচজনকে গুরুতর আহতাবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের বিছানায় আঘাতের যন্ত্রণা নিয়েই টুটুল সাংবাদিকদের বলেন, বন্ধু অভিজিত হত্যার আগে থেকেই অনেকবারই হুমকি-ধমকি পেয়েছিলেন তিনি। এ কথা বলার কিছুক্ষণ পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্ত্রী শামীম রুনা সাংবাদিকদের বলেন, অনেক দিন ধরে আহমেদুরকে অনুসরণ করা হচ্ছিলো। হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছিল। এ কারণে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছিলেন।
তবে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিনের কাছে এব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে আমি এসেছি মাত্র আড়াই মাস হলো। জিডির কথা শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। খোঁজ নেয়া হচ্ছে। থানার নথিপত্র ঘেঁটে দেখছি।’
এব্যাপারে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর করিব নানক পুলিশি নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার তাকে বলেন, আমাদের মোহাম্মদপুর থানায় একটা জিডি করেছিলেন তিনি।
আমরা জিডির পর নিরাপত্তার বিষয়ে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু তিনি আমাদের নিরাপত্তার কাজে সহযোগিতা করেননি। তার কার্যালয়ের সামনে পুলিশ টহলে থাকলে তিনি বিব্রতেবোধ করতেন। পুলিশ তার কার্যালয়ে গেলেও কখনো কার্যালয়ের ভেতরে আসতে দিতেন না।
গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে ফেসবুকে নিজের মৃত্যু ভীতির কথাও লিখেছিলেন আহমেদুর রশীদ। গত ৯ জুলাই ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘ঘুম থেকে জেগে দেখি খুন হয়ে গেছি। কারা যেন আমার কবজি দিয়ে বানানো কাবাবের দিকে তাকিয়ে কাঁটা চামচ খুঁজছে। কবজির পাশে ওয়াইনে ভিজিয়ে রেখেছে আমার স্বপ্নাকাতুর চোখ।...’
চার মাস পরেই সেই তিনিই কি-না বীভৎসতার মুখোমুখি। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিনি হয়েছেন রক্তাক্ত। বই প্রকাশনা ও ব্লগে লেখালেখিতে নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছিলেন টুটুল। তবে আতঙ্ক ভীতি আর প্রতিবাদ ও ক্ষোভের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। বন্ধু অভিজিৎসহ বিভিন্ন ব্লগার খুনের ঘটনায় প্রকাশ করেছেন তীব্র ক্ষোভ।
১৫ অক্টোবর আহমেদুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লেখক খুন, ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি ঘটনার প্রতিবাদে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের লেখকেরা তাদের অর্জিত পুরস্কার এবং সম্মাননা ফিরিয় দিয়ে, প্রত্যাখ্যান করে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতার নজির স্থাপন করেছেন।...বাংলাদেশে গত তিন বছরে শুধু লেখার জন্য খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন লেখক। অনেক লেখক খুনের হুমকি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। গেল ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় প্রকাশ্যে অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার পর আমাদের বেশির ভাগ পরিচিত লেখকই মুখ খোলেননি, প্রতিবাদ জানাননি। রাজিব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি নীল: এদের কারওর জন্যই যাদের করার কথা, তারা কেউ এমন কিছু করেননি যাতে রাষ্ট্রের এবং সমাজের টনক নড়তে পারে। এ দীনতা লজ্জার, খুব আতঙ্কের..।
গত ১৮ অক্টোবর নিজেরই একটা পোস্ট আবারো শেয়ার করেন তিনি। সেখানে তিনি লেখেন, “আমি গুম হয়ে আছি, নাকি ঘুমের ভেতর / নাকি অজানা এক জ্যামের ভেতর আটকে থাকা রংধনুর চুম্বন কপালে এঁকে / যারা যারা চলে গেলো পাশ দিয়ে...”।
জেইউ/বিএ