‘দুর্বল’ হলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় জঙ্গিরা
জঙ্গিবাদের উত্থান আরও আগে হলেও সামর্থ্য ও সংগঠন সম্পর্কে প্রথম জানান দেয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে সারাদেশে বোমা হামলা চালানোর মধ্যদিয়ে। এরপর উদীচী, ছায়ানটের অনুষ্ঠান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও আওয়ামী লীগের সমাবেশেও জঙ্গি হামলার প্রমাণ মেলে।
বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ওই সিরিজ বোমা হামলা ছিল একটি সফল হামলা। কারণ জেএমবির উদ্দেশ্যই ছিল সারাদেশে একযোগে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা এবং বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের জানান দেয়া।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত আটটি জঙ্গি সংগঠন ছাড়াও উগ্র মতাদর্শী সংগঠনগুলোর সেই সাংগঠনিক সামর্থ্য নেই। জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও বড় হামলা চালানোর সামর্থ্য আর নেই জঙ্গিদের।
তবে নিজেদের জানান দেয়ার চেষ্টায় থেমে নেই জঙ্গিরা। যার নজির পাওয়া গেছে সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায়।
২০১৫ সালের দিকে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা প্রকাশ পেতে থাকে। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজিব হায়দার ওরফে শোভনকে হত্যা করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি তালিকায় থাকা মার্কিনপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় হত্যা করা হয় মূলত ফেসবুকে লেখালেখি করা ওয়াশিকুর রহমানকে। ১২ মে সিলেটে হত্যা করা হয় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে।
২০১৬ সালে হলি আর্টিসান বেকারিতে নৃসংস হামলার ঘটনা ঘটে। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করা ওই ঘটনায় জঙ্গিরা ওই রাতে দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিককে হত্যা করে। নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। এরপরই ৭ জুলাই শোলাকিয়া ঈদগাহের অদূরে হামলা চালায় নব্য জেএমবির সদস্যরা। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। গুটিয়ে যেতে থাকে জঙ্গিরা। সাঁড়াশি অভিযানে শীর্ষনেতাসহ অন্তত ৬৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য মেলে।
এরপর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। এরপরও জঙ্গিদের ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা দেখা যায় বেশ কয়েকটি ঘটনায়।
২০১৭ সালে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণ, গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বোমার বিস্ফোরণ, মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) কার্যালয়ের সামনে পুলিশের গাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ, খামারবাড়ি ও পল্টনে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে একই সময় দুটি কার্টনে বোমা পাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে জঙ্গিরা।
গত ১৯ জুলাই সারাদেশে পুলিশের ইউনিট প্রধানদের চিঠি পাঠিয়ে পুলিশ সদর দফতর জানায়, আইএস মতাদর্শের দেশীয় অনুসারী ‘নব্য জেএমবির’ সদস্যরা যেকোনো সময় ‘আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা’ পরিচালনা করতে পারে। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনসহ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয় চিঠিতে।
এরপর সিলেট থেকে নব্য জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের পর ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানায়, সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে ‘হামলার পরিকল্পনা ছিল’ নব্য জেএমবির।
‘জঙ্গিরা কি আবার সংগঠিত হচ্ছে?’-এমন প্রশ্নে সিটিটিসি প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘হরকাতুল জিহাদ কিংবা জেএমবির যে ক্যাপাসিটি গড়ে উঠেছিল গত কয়েক বছরে তা আর নেই। এখন বলতে গেলে খুবই নগণ্য সামর্থ্য।’
তিনি বলেন, ‘টেকনোলজির এই যুগে তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডা অনেক বেশি। তবে ২০০৫ সালের মতো সামর্থ্য তাদের গড়ে ওঠেনি। তারপরেও যেটুকু গড়ে উঠেছিল তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। উগ্রবাদী চিন্তা বা জঙ্গিবাদ বিস্তার ঘটতে পারে এমন অনেক কারণ এখনো সমাজে বিদ্যমান আছে। ফলে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যাতে করে আবারো উগ্রবাদীরা সংগঠিত হয়ে কোনো হামলা না চালাতে পারে।’
তবে জঙ্গিদের প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা দুটোই আছে বলে মনে করেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে বড় ধরনের হামলা করার মতো সামর্থ্য তাদের গড়ে ওঠেনি। বড় ধরনের হামলার সুনির্দিষ্ট তথ্যও আমাদের কাছে নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবির নতুন আমির সালাহউদ্দিন সালেহীন কোথায় জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, পুরোনো জেএমবির বিশেষ অ্যাক্টিভিটি আর নেই। অনেকটাই তাদের সক্ষমতা কমে গিয়েছি। যদিও সালেহীন ধরা পড়েনি। তিনি ভারতে অবস্থান করছে বলে আমরা জেনেছি।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯ মামলা হয় এবং এ পর্যন্ত অভিযোগ গঠন করা হয়েছে ১৪৩টির। আর অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে ১১৬টির। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ৯৮৮ জন।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জঙ্গিরা চেষ্টা করছে নতুন নতুন সদস্য রিক্রুট করার। সেজন্য তারা অনলাইনে প্রচারণাও চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সাইবার পেট্রোলিং এবং সাইবার সার্ভিলেন্সের কারণে ধরাও পড়ছে।’
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এলেও নির্মূল হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। যে কারণে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একজনের পর আরেকজন হাল ধরার চেষ্টা করলেও সাংগঠনিক ভিত্তি তাদের এখন অনেক দুর্বল।’
‘জঙ্গিরা প্রায় ৮২ শতাংশ অনলাইনে কার্যক্রম চালায়। একটি মতবাদ কেউ অনলাইনে দিলে পাল্টা মতবাদও দেয়া হয়। তাই কেউ যাতে ভ্রান্ত ধারণায় ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য সারাদেশে অ্যাওয়ারনেস বিল্ডিংয়ের কাজও চলছে’, বলেন অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব তার ম্যানডেটের আলোকে জঙ্গি দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। র্যাব আজ পর্যন্ত দুই হাজার ৩১২ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।’
‘২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় র্যাব ৬৭ জন আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। তার মধ্যে তৎকালীন জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানি উল্লেখযোগ্য। তাদের ফাঁসির আদেশ ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে হলি আর্টিসান হামলা পরবর্তী দেশে জঙ্গি দমনে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছি। যখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে তখনই আমরা তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করে তছনছ করে দিয়েছি। বর্তমানে র্যাবের গোয়েন্দা ও আভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
জঙ্গিকে পুনর্বাসন
গুলশান হামলার পর অভিযানের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তরুণদের সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার কাজও শুরু হয়। র্যাব এবং পুলিশের মাধ্যমে এরই মধ্যে ৮০ জনকে সংশোধনের পর পুনর্বাসন করা হয়েছে। সিটিটিসির উদ্যোগেই ৫০ জন জঙ্গিকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনকে আর্থিকভাবে এবং ৪২ জনকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেতে ও সামাজিকীকরণে সহায়তা করেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে সিটিটিসি প্রধান মনিরুল জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত অর্ধশত জঙ্গিকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। দেশে জঙ্গিবাদে জড়িতদের অধিকাংশ তরুণ-যুবা; তাদের বিভ্রান্তির পথ থেকে সরিয়ে আনতেও কাজ করছে পুলিশ।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জঙ্গিকে পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। সেজন্য কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। পুলিশ কিংবা র্যাব নিজেদের উদ্যোগে সেটি শুরু করলেও সরকারিভাবে তা শুরু করা গেছে কি-না আমার জানা নেই।’
বৈশ্বিক যুগে শুধু অপারেশনাল কাজের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নির্মুল করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভ্রান্ত ধারণায় ও উগ্র ধারণাকে যাতে তরুণ-যুবারা ধারণ না করে সেজন্য ডি-রেডিক্যালাইজেশন অত্যাবশ্যক।
অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, বড় আকারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুনর্বাসনের কাজ করতে হবে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান, গ্রেফতারের পাশাপাশি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সঠিক পথে ফেরাতে হবে।
জেইউ/এসআর/জেআইএম