বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিরা কে কোথায় সঠিক তথ্য নেই
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের মধ্যে পাঁচজনের রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি। এমনকি এই পাঁচ আসামির মধ্যে আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ।
এক দশক পর আসামিদের মধ্যে একজন আবদুল মাজেদকে গত ৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতের রায় অনুযায়ী তাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ছয়জনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। অপর ছয়জনের মধ্যে পাচঁজন এখনো বিদেশে পালাতক। এরা হলেন-খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এবিএমএইচ নূর চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও রাশেদ চৌধুরী।
সরকারের তথ্যমতে, রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং নূর চৌধুরী কানাডায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন। বাকিদের সম্পর্কে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য নেই। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কয়েক বছর ধরেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। যদিও খুনিদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
আর অবশিষ্ট তিনজনের বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য সরকারের কাছে না থাকলেও পুলিশ এবং গোয়েন্দা সস্থার দাবি, এ তিনজন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করছেন।
তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা জারি অব্যাহত রয়েছে। দণ্ডিত অপরজন আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন।
খন্দকার আবদুর রশিদ কোনো সময় পাকিস্তানে কোনো সময় লিবিয়ায় আর শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তানে রয়েছেন বলে খবর প্রকাশ পায়।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে পলাতকদের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এ নোটিশ জারি হয়। এরপর প্রতি পাঁচ বছর পরপর এ নোটিশ নবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। অন্যদের মধ্যে মোসলেহ উদ্দিন ভারত অথবা পাকিস্তানে আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে পাকিস্তানকে বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। আর ভারত বলেছে, মোসলেহ উদ্দিন তাদের দেশে নেই। আব্দুর রশিদ ফ্রান্স, ইতালি, লিবিয়া, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে কোনো একটি দেশে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর শরিফুল হক ডালিম চীন, ইংল্যান্ড, হংকং, কেনিয়া, লিবিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে কোনো এক দেশে থাকতে পারেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে চিঠি পাঠিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হলেও প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কানাডায় বসবাসরত নূর চৌধুরীকে দেশটির সরকার ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করায়। কারণ কানাডায় মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। অপরদিকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এড়িয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে হয়তো রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে দুজনকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘জাতি ১৫ আগস্ট ৪৫তম জাতীয় শোক দিবস পালন করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতকদেরকে দেশে আনতে কূটনৈতিক ও আইনি প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে লবিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, যদিও তারা কোথায় লুকিয়ে আছে সে ব্যাপারে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হতে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সরকারগুলো খুনিদের বিচার না করে বিভিন্ন সময় পুনর্বাসন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিদেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক মিশনে চাকরিও দেন।
তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘপথ পরিক্রমা শেষে ২০১০ সালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদের দণ্ড কার্যকর হয়। এ রায় কার্যকরের আগে ২০০১ সালে একজন আসামি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেন। রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন পাঁচ আসামিকে। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
নিয়ম অনুযায়ী ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন তিনজনকে।
আসামিদের আবেদনের পর ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্ব তিন বিচারপতির বেঞ্চ পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিন ওই বছরের ৪ অক্টোবর সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। শুনানি শেষে ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। এরপর আসামিদের করা পুনর্বিবেচনার আবেদনও ২৭ নভেম্বর খারিজ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। ১৯৯৬ সাল পযর্ন্ত তারা দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসে কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়।
লে. কর্নেল রাশেদ চৌধুরী ১৯৮৪ সাল পযর্ন্ত নাইজেরিয়ায় কনস্যুলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সর্বশেষ বদলি হয় টোকিওতে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে।
এফএইচ/এসআর