নগরে গ্রামীণ হাট
গ্রামগঞ্জে সাপ্তাহিক হাটের সঙ্গে সবাই পরিচিত। নির্দিষ্ট বারে মাছ, মাংস থেকে শুরু করে শাক-সবজি, খাবার-দাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি খেলনাসহ শত শত পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। এই হাটে কেনাকাটা করতে দূর-দূরান্ত থেকে আসে মানুষ। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগম হয়ে ওঠে পুরো হাট।
ইট-পাথরের নগরজীবনে সাপ্তাহিক হাটের বিষয়টি অনেকের কাছেই অপরিচিত। তবে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে যারা বাস করেন, তাদের অনেকেই এই সাপ্তাহিক হাটের সঙ্গে পরিচিত। নগর জীবনে তাদের এই গ্রামীণ হাটের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করে রেখেছে শত বছরের পুরোনো মেরাদিয়া হাট। অনেকে এই হাটকে বলেন ‘মেরাইদ্দা হাট’। প্রতি বুধবার বসে এই হাট।
জানা যায়, রাজধানীর বনশ্রী সংলগ্ন এই হাটে দীর্ঘকাল থেকেই রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কেনাবেচা করে আসছেন। হাটের দিন সড়ক বা নৌপথে ক্রেতা-বিক্রেতারা আসছেন এখানে। হাটের দিন নড়াই নদীর বা রামপুরা খাল পাড়ে এসে অনেক নৌকা ভিড়ত আগে। এখনো নৌকা আসে, তবে সে সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।
লোকমুখে আগে প্রচলন ছিল, মেরাদিয়া হাটে সুঁই থেকে শুরু করে হাতিও মেলে। কিন্তু কালের বিবর্তনে হাটটি এখন আর আগের মতো জমজমাট নয়। তবু সপ্তাহের প্রতি বুধবার রাজধানীসহ আশপাশের স্থান থেকে হরেক রকমের পণ্য নিয়ে এখানে আসেন বিক্রেতারা, আর সেসব পণ্যের আকর্ষণে আসেন ক্রেতারাও।
এ সপ্তাহের (বুধবার) হাট ঘুরে দেখা যায়, এখানে দা, বঁটি, কাচের জিনিস, কাঠের ব্যবহার্য জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, হাড়ি-পাতিল, বাঁশের তৈরি পণ্য, কুটির শিল্পের সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালি দ্রব্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। রয়েছে মাছ ধরার পলো, বড়শি, বাঁশের তৈরি টুকরি, কুলা, খলই, মোড়া, পাটি, ছনের ঝাড়ু। এছাড়া ডাব, নারিকেল, বেল, পেঁপে, লেবু, কলা, আখসহ দেশি-বিদেশি নানা রকমের ফলও উঠেছে হাটে।
নানা ধরনের মাছের পাশাপাশি টাটকা সবুজ সবজিও দেখা যায় হাটে। এছাড়া ঢাকার পাশের গ্রামীণ জনপদ থেকে আসা টাটকা মাছ, শুঁটকি, দেশি মুরগি, কবুতর, দেশি ছাগল, গাভীর খাঁটি দুধ, জামা-কাপড়, খেলনাসহ মুখরোচক নানা খাবারও উঠেছে হাটে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কাপড়ের দোকান। তুলনামূলক কম দামে বিভিন্ন ধরনের জামা-কাপড়, বিছানার চাদরের দোকানগুলোতে ভিড় দেখা যায় নিম্ন ও নিম্নবিত্ত ঘরের নারীদের।
পাশের নন্দীপাড়া থেকে মেরাদিয়া হাটে আসা বয়োবৃদ্ধ আনসার আলী বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই এই হাটে কেনাকাটা করতে আসি। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে এই হাটে আসতাম। আগে এই হাট ছিল খুব জমজমাট। দূর-দূরান্ত থেকে সপ্তাহের হাটবারে এখানে আসতো লোকজন। সুঁই থেকে শুরু করে হাতিও পাওয়া যায় মেরাদিয়া হাটে- লোকমুখে আগে থেকেই এই কথার প্রচলন ছিল। হাটবার নড়াই নদে বা রামপুরা খাল পাড়ে এসে ভিড়ত শত শত নৌকা ও ট্রলার। এসব বোঝাই করে পাইকাররা মালামাল আনতো, কিনে নিয়ে যেত। এখনো নিয়মিত বুধবার এই হাট বসে; তবে আগের জৌলুশ হারিয়েছে। কারণ এখন আর বাজারের, দোকানের অভাব নেই কোথাও। অলি-গলিতেই মার্কেট রয়েছে এখন।
রাজধানীর মালিবাগ থেকে হাটে এসেছেন হাবিবা খাতুন নামের একজন গৃহিণী। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই এই হাটের সুনাম শুনে আসছি। এখানে তুলনামূলক কম দামে নানা রকম কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়। এছাড়া বিছানার চাদরসহ টাটকা শাক-সবজি, মাছ-মাংসও পাওয়া যায়। তাই প্রায় বুধবার এই হাটে আসি।
হাটে বাঁশের তৈরি নানা পণ্য বিক্রি করছিলেন পুরোনো দোকানদার শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার বাবা আগে থেকেই এই হাটে এসব পণ্য বিক্রি করতেন। আশপাশে আগে বড় বড় খাল, নদীপ্রবাহ ছিল। তাই মাছ ধরার নানা পণ্যের চাহিদা আগে থেকেই আছে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে এখানে হাটবার আমি এই অস্থায়ী দোকান করি। এই হাট অনেক পুরোনো এবং নাম-ডাকও আছে হাটটির। গ্রামগঞ্জের অন্যান্য হাটে যা পাওয়া যায়, শহরের এই হাটে সেসবই পাওয়া যায়।
এদিকে এই হাটের একটি বড় অংশে গড়ে ওঠা অবৈধ কিছু স্থাপনা গত ১৫ জুলাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এখানে একটি আলাদা বাজার ২০১০ সাল থেকে অবৈধভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। অভিযানে বিপুলসংখ্যক কাঁচা, পাকা, আধাপাকা ও বহুতল ভবন ভেঙে দেয়া হয়েছে।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মেরাদিয়া হাটের জায়গাটি ১৯৭৯ সালে সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে বাজার ইজারা দেয়া হয়। এরপর ইজারা দেয়া না হলেও অসাধু চক্র অনুমতি ছাড়াই একটি বাজার চালু রাখে। এটি গুঁড়িয়ে দেয় ডিএসসিসি। উদ্ধার করা হয় ১১৮ শতাংশ জমি।
অভিযানের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপ-সচিব সুয়ে মেন জো জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জায়গায় অবৈধভাবে দখলকারীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের নির্দেশে সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ তাদের জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত জায়গাটি এখন তাঁরকাটা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছেন। এ জায়গা বাদ দিয়ে অন্যান্য স্থানে হাট বসছে। তাঁরকাটা দিয়ে ঘিরে রাখা স্থানে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা আছে, ‘তফসিলভুক্ত এই জমির মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জমির পরিমাণ ১.১৮০০ একর। এই সম্পত্তিতে জনস্বার্থে উন্নয়নমূলক কাজ করা হবে।’
এএস/এইচএ/জেআইএম