গো-খাদ্য সংকটে স্বাস্থ্যহানি ঘটছে কোরবানির পশুর
দেশের ১৭ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এ সময় কোরবানির পশুর জন্য অতিরিক্ত খাবার প্রয়োজন হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত খাবার তো দূরের কথা ন্যূনতম খাবারও পাচ্ছে না কোরবানির পশু। খড়ের গাদা পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে, মাঠের আবাদি ঘাসও ডুবে গেছে। উঁচু জমিতে যে ঘাস ছিল অতি বৃষ্টির কারণে সেগুলোর গোড়া পচে গেছে। ফলে গো-খাদ্যের তীব্র সংকটে কোরবানির পশুর স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। ঠিকমতো খাবার দিতে না পেরে ৮০ হাজার টাকার গরুর দাম এখন ৬০ হাজারে নেমেছে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার উল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক হেলাল খান জাগো নিউজকে বলেন, এবার বোরো মৌসুমে প্রতিদিন বৃষ্টির কারণে ধান গাছের অর্ধেক কাটতে হয়েছে। সেটাও অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে। ওই সময় ধান শুকানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন গৃহস্থরা। বৃষ্টি কারণে বলা চলে বোরো ধানের খড় প্রায় সব নষ্ট হয়েছে। এখন বন্যার কারণে অনেকের ঘাসের জমি পানির নিচে। অনেক গৃহস্থ উঁচু জমিতে ঘাস করেছিল, সেখানে এখনো পানি উঠেনি। কিন্তু প্রতিদিন বৃষ্টির কারণে ঘাসের গোড়া পচে গেছে। ফলে ঘাসের গোড়া থেকে আর কুশি জন্মাচ্ছে না।
তিনি বলেন, যারা কোরবানির জন্য মোটাতাজা করেছেন সারাবছর ধরে এখন সে গরু তাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরুগুলোকে ঠিক মতো খেতে দিতে পারছে না আবার দাম কমের কারণে বিক্রিও করতে পারছে না।
গোবিন্দগঞ্জের গণমাধ্যমকর্মী রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, কোরবানিকে সামনে রেখে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, গোবিন্দগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ সারাবছর ধরে পশু পালন করেন। কুড়িগ্রামে বন্যায় গরু-ছাগল নিয়ে সংকটে আছে অনেক কৃষক। তাদের খাদ্য দিতে পারছে না। বিশেষ করে কোরবানি যোগ্য পশুগুলো খাদ্য না খেয়ে কাবু হয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামের খামারিরা জানান, চরের মানুষের প্রধান সম্পদ গবাদি পশু। কোরবানির সময় অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখেন। কেউ বা শোধ করেন ঋণ। কিন্তু এবারের দৃশ্যটা একেবারেই ভিন্ন। করোনা ও বন্যার প্রভাবে কোরবানি পশুর দাম কমে গেছে।
কুড়িগ্রামের হলোখানা গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, বাড়িতে বন্যার পানি ওঠার পর বাঁধের ওপর গরু রেখেছেন। ঘাস খাওয়াতে পারছেন না। ভূষির যে দাম তাতে সেগুলোও কিনে খাওয়ানো কঠিন একজন গরীব কৃষকের পক্ষে। কোরবানিতে বিক্রির জন্য গরু পালন করেছেন কিন্তু বিক্রি করতে পারছেন না। ৫০ হাজার টাকার গরু এখন ৩০ হাজার টাকা হয়ে গেছে।
গাইবান্ধার ভাষার পাড়া গ্রামের মালেক মিয়া (৬০) বলেন, ‘তিনটা গরু নিয়া বাঁধের ওপর কোনোমতে চালা তুলি আছি। গরুর খড় শেষ হয়া গেছে। নিজের খাবারই জোটে না, গরুক কি খাওয়ামো। কোরবানির হাটে বেচবার জন্য গরু পাইলছি কিন্তু এখন কেনার মতো লোক নাই। হাটও বন্ধ।’
জাগো নিউজের নাটোর সংবাদদাতা জানান, জেলার চলনিবলের অংশ এখন বন্যা কবলিত। বন্যাদুর্গত এলাকায় গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো বেশির ভাগ এলাকায় কোমর পানি। এ কারণে পানিতে মাঠ-ঘাট, ফসলি জমি এমনকি চাষ করা ঘাসের জমিও ডুবে গেছে। বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে খড়ও। বানভাসিরা রাস্তা, উঁচু স্থান ও বাঁধে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। গো-খাদ্যের সংকটে ক্রমেই গবাদিপশু দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে কোরবানির ঈদে গবাদিপশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক ও খামারিরা।
চলনবিলের কৃষক আল আমিন জানান, এখনো রাস্তায় আছি। বাড়ির মধ্যে পানি শুকায়নি। গরুকে তো খাবার দিতে পারি না। এজন্যই রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি। বন্যার কারণে গরু শুকিয়ে গেছে। আগে ৮০-৯০ হাজার দাম উঠছে, এখন বলছে ৭০-৭৫ হাজার।
আত্রাইয়ে গবাদিপশুর একমাত্র খাদ্য খড়ে বন্যার পানিতে পচন ধরেছে, আবার কোথায়ও ভেসে গেছে। এ কারণে গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। এছাড়া সরকারিভাবে কোনো ধরনের গো-খাদ্য সরবরাহ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন গবাদি পশুর মালিক ও জনপ্রতিনিধিরা।
ইয়ার আলী নামে এক কৃষক জানান, প্রতিটি পশুর জন্য দিনে এক কেজি দানাদার খাদ্য ও তিন কেজি খড়ের প্রয়োজন। নিজেরা কোনো রকম দুই বেলা খাবার পাইলেও গরুর জন্য খাবার জোগাড় করতে পারছি না। চারদিকে পানি, কোনো ঘাস নেই। গরুর জন্য রাখা খড় পানিতে ডুবে গেছে। গরু নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
নেত্রকোনা সংবাদদাতা বলেন, বন্যায় গো-খাদ্যের সংকটে পড়েছেন কলমাকান্দা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের বানভাসি মানুষ ও খামারিরা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ উঁচু বাঁধ ও রাস্তার ধারে নিরাপদ স্থানে গবাদিপশু সরাতে পারলেও পশুখাদ্য সরাতে পারেননি। গবাদিপশুর একমাত্র খাদ্য খড় বন্যার পানিতে পচন ধরেছে, আবার কোথাও ভেসে গেছে। এ কারণে গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
গো-খাদ্য সংকটের কথা স্বীকার করে কলমাকান্দা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, উপজেলায় এখন পর্যন্ত গবাদিপশুর খাদ্য সরকারিভাবে বরাদ্দ নেই। আমরা ইতিমধ্যেই মেডিকেল টিম করে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় গবাদিপশুর চিকিৎসা দিয়ে আসছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়েছি।
সুনামগঞ্জে প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার গৃহপালিত পশু বন্যাকবলিত হয়েছে। হাঁস-মুরগি মিলিয়ে এই সংখ্যা ২৫ লাখ বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। কোরবানিরকে সামনে রেখে জেলায় ৪৭ হাজার গরু মোটাতাজা করেছিলেন কৃষক ও খামরিরা। দুই দফা বন্যায় এসব গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন পশু মালিক। পশুর চারণ ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে পশু-খাদ্যের অভাব। এমন পরিস্থিতিতে কম দামেও পশু বিক্রি করতে পারছেন না অনেকে।
এফএইচএস/এএইচ/এমএস