ফসলের সঙ্গে বন্যায় ডুবেছে কৃষকের স্বপ্নও
উত্তরাঞ্চলে সবজি ক্ষেত বলতে আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না। দ্বিতীয় দফা বন্যায় ডুবেছে নিম্নাঞ্চলের সবজি ক্ষেত। এছাড়া টানা বৃষ্টিতে সবজি ক্ষেতের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়ায় উঁচু জমির সবজি ক্ষেতও মরে গেছে। বগুড়া মহাস্থান বাজারের আড়তদার মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আগামী এক দেড় সপ্তাহের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে সবজির দাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কারণ উত্তরাঞ্চলে সব সবজি বাগানই নষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন বগুড়া থেকে সারাদেশে সবজি যেত, এখন যে সব জেলায় বন্যা হয়নি সেখান থেকে সবজি আনতে হবে।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফার বন্যায় উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নওগাঁ, লালমনিরহাট ও রংপুরের বিভিন্ন উপজেলার ৪২ হাজার ১৮১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে ২০ হাজার ৭৩৭ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১০ হাজার, বগুড়ায় ৮ হাজার ৭৫৪, নওগাঁয় ২ হাজার ২৩৪, লালমনিরহাটে ৩৮৭ ও রংপুরে ৬২ হেক্টর জমির ফসল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বগুড়ার সাংবাদিক রুবেল জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের সব হাট-বাজারেই এখন তরকারি খুব সস্তা। কারণ সবজির ক্ষেত নষ্ট হওয়া এবং ডুবে যাওয়ায় সবাই শেষবারের মতো সবজি তুলে বাজারে নিয়ে আসছে। সপ্তাহ খানেক পরেই আর সবজি পাওয়া যাবে না। যা পাওয়া যাবে দাম অনেক বেশি হবে। নতুন করে সবজি বাগান না করা পর্যন্ত সবজির অভাব থাকবে।
তিনি বলেন, বগুড়ার গোসাইবাড়ি-ভান্ডার বাড়ি এলাকার ভূতমারি চরে অনেক চাষি পটল, করলা, চালকুমড়া চাষ করেছিলেন সেগুলো পানিতে ডুবে গেছে। যেখানে বন্যার পানি ওঠেনি সেখানে অতিবৃষ্টির কারণে সবজি গাছের গোড়া পচে গাছ মারা গেছে।
বগুড়ার জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আজহার মন্ডল জানান, এখন পর্যন্ত জেলায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৭৫৪ হেক্টর। আর ৩০ হাজার ৬২২ পরিবারের ১ লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম জানান, বন্যায় শুধু সারিয়াকান্দিতেই প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার দ্বিতীয় দফায় পানি বেড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে চরে চাষ করা পাট, কাউন, আউশ ধান, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল। পানি কিছুটা কমলে ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে।
সিরাজগঞ্জ জেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফার বন্যায় জেলার প্রায় ৫১টি ইউনিয়নের ২৫০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করে নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এখানে সবজির সকল বাগান নষ্ট হয়ে গেছে।
কাজীপুর উপজেলার ফুলজোড়ের কৃষক সামাদ জানান, তিনি দুই বিঘা উঁচু জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন। সেখানে বন্যার পানি ওঠেনি। কিন্ত গত ৮/১০দিন ধরে টানা বর্ষণে সবজি গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে গাছ মরে গেছে। অনেক গাছের গোড়ায় পানি জমে পচে গেছে। ফলে পুরো ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হাবিবুল হক জানান, বন্যায় এখন পর্যন্ত পাট, আখ, তিল, কাউন ও সবজিসহ ২০ হাজার ৭৩৭ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ৯ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমির পাট তলিয়ে গেছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে এ ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।
কুড়িগ্রামে খবর নিয়ে জানা গেছে, বন্যায় জেলার নয় উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে সাত হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ তিন সপ্তাহব্যাপী বন্যায় চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের বীজতলা, আউশ ধানক্ষেত, পটল, ঢ্যাঁড়সসহ বিভিন্ন শাক-সবজি ক্ষেত, ভুট্টা, চীনাবাদাম, কাউন, তিল, মরিচ ও পাট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে সাত হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। আর বাকি তিন হাজার হেক্টর জমির ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, এ পর্যন্ত জেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমির বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি ক্ষেতের হিসাব নিরূপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাত হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল আংশিক নষ্ট হয়েছে। বন্যার পানি দ্রুত নেমে না গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। জেলায় মোট ৫৩০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে ১৫০ হেক্টর কমিউনিটি বীজতলা তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
বন্যায় নওগাঁ জেলার দুই উপজেলায় ২ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রাকিবুল হাসান জানান, উপজেলায় ৬০০ হেক্টর আউশ ধান, ২০ হেক্টর আমনের বীজতলা, ২০ হেক্টর সবজি ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আত্রাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কাওসার হোসেন জানান, উপজেলার ১ হাজার ১৪৫ হেক্টর আউশ ধান, ৫০ হেক্টর রোপা আমন ধান, ২৪৩ হেক্টর আমনের বীজতলা, ১১ হেক্টর মরিচ, ৭৫ হেক্টর সবজি ক্ষেত এবং ৭০ হেক্টর পাটক্ষেত তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত উপজেলায় ১ হাজার ৫৯৪ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার ৩৮৭ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, জেলায় ১৯০ হেক্টর আমন বীজতলা, রোপা আমন ১৭১ হেক্টর, আউশ ১৬ হেক্টর ও ১০ হেক্টর সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। রোপা আমন ও আউশ ধানের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে সবজির ক্ষতি বেশি হতে পারে।
রংপুরে দ্বিতীয় দফার বন্যায় তিন উপজেলার প্রায় ৬২ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৬২ হেক্টর রোপা আমন, ভুট্টা, পাট ও শাক-সবজির জমি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলায় পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে আট হেক্টর, কাউনিয়া উপজেলায় ৩৩ হেক্টর ও পীরগাছা উপজেলায় ২১ হেক্টর জমির ফসর পানিতে ডুবে গেছে। পানিতে নিমজ্জিত হলেও এখনো ফসল নষ্ট হয়নি বলে দাবি করেছে কৃষি বিভাগ।
বগুড়ার মহাস্থান বাজারের আড়ৎদার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় বন্যার পানি ওঠার কারণে সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে তরিঘড়ি করে সবজি তুলে বাজারে নিয়ে আসছে। ফলে মোকামে সবজির দাম কিছুটা কম। তবে দেড় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির দাম দ্বিগুণ হবে। তিনি বলেন, আজ বৃহস্পতিবার মহাস্থান বাজারে পটল প্রতিকেজি ১৪ টাকা, পেপে ১৮ টাকা, কাকরোল ১৮/২০ টাকা, চিচিংগা ১৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ১২ টাকা, পানিলাউ ২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া (মাঝারি সাইজ) ২০ টাকা, জালি কুমড়া ১৫/১৬ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।
এফএইচএস/এমএফ/পিআর