সাহেদের পাসপোর্ট-ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক জব্দ, আরও ২৩ মামলার সন্ধান
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা ও আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নামে প্রতারণা করা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদের পাসপোর্ট জব্দ করেছে তদন্তকারী দল। হদিস মিলেছে তার বিরুদ্ধে আরও ২৩ মামলার। সর্বমোট ৫৬টি মামলার আসামি প্রতারক সাহেদ।
রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর গ্রেফতারদের মধ্যে রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার (১১ জুলাই) হাসপাতালটিতে ও রিজেন্ট কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে তদন্তকারী দল। অভিযানকালে গুরুত্বপূর্ণ আলামতসহ পাসপোর্ট জব্দ করে তারা।
তদন্তকারী দলের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাহেদ দেশত্যাগ করতে পারে, এমন শঙ্কা ছিল। রিমান্ডে থাকা আসামিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আজ আবারও অভিযান পরিচালনা করা হয় রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখান থেকে সাহেদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এখন অন্তত সাহেদ কোনো এয়ারপোর্ট বা বন্দর হয়ে দেশত্যাগ করতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘অভিযানকালে আমরা রিজেন্ট কার্যালয়ের রান্নাঘর থেকে কম্পিউটারের তিনটি হার্ডডিস্ক জব্দ করেছি। এর মধ্যে সাহেদের ল্যাপটপের হার্ডডিস্কও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ধরা পড়ার শঙ্কায় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি গায়েব করার উদ্দেশে হার্ডডিস্কগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমরা হার্ডডিস্ক বিশ্লেষণ করব, ফাইল ডিলিট করা হলে সেগুলো উদ্ধার করে খতিয়ে দেখা হবে।’
তদন্তকারী এ দলের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক অভিযান পরিচালনাকারী র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। তিনি সিলগালা করা কার্যালয় খুলে দেন।
আজকের অভিযান শেষে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমরা জানতাম, সাহেদের নামে ৩২ মামলা রয়েছে। অভিযানের পর তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। তবে এরপর নানা দিক থেকে তথ্য ও অভিযোগ আসতে থাকে। ভুক্তভোগীরা র্যাব ও থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সর্বশেষ আমরা আরও ২৩টি মামলার হদিস পেয়েছি। সবমিলিয়ে, সাহেদের বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা রয়েছে। এর অধিকাংশ মামলাই প্রতারণা ও ব্যবসায়িক জালিয়াতি সংক্রান্ত।’
নানা অনিয়ম, প্রতারণা, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ ও করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও গ্রেফতার হয়নি চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. শাহেদ। র্যাবের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পর সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ।
গত বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) পুলিশের পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশন বিভাগকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়। সাহেদ যেন দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য সম্ভাব্য সকল বিমানবন্দর, স্থল ও নৌবন্দরে সতর্কাবস্থায় রয়েছে পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায়ও সতর্ক রয়েছে বিজিবি।
র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের নবনিযুক্ত পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা সাহেদকে গ্রেফতারে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। র্যাব তার (সাহেদ) স্ত্রী রিমিসহ ঘনিষ্ঠ সকলের ওপর নজর রাখছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যে প্রতারক সাহেদ চক্রের অনুমোদিত মেডিকেল স্বাস্থ্য সামগ্রী ইক্যুইপমেন্ট জব্দ করা হয়েছে, জব্দ করা হয়েছে টেস্টিং কিট। ধারণা করা হচ্ছে- তিনি এসবের ব্যবসার পরিকল্পনা করছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘বালু-পাথরের ব্যবসা করতে গিয়েও প্রতারণা করেছেন সাহেদ। সেই অর্থ প্রতারণার দায়ে মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সিলেটের জৈন্তাপুরের ব্যবসায়ী শামসুল মাওলার কাছ থেকে ৩২ লাখ টাকার মালামাল নেয়ার পর পরিশোধ করেন মাত্র ২ লাখ। বাকি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য চেক দেন। কিন্তু ব্যাংকে চেক বাউন্স হওয়ার পর ওই ব্যবসায়ী মামলা দায়ের করেছেন। সেটিও তদন্ত চলছিল। এরকম অর্ধশত ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ আমরা আমলে নিচ্ছি।’
এর আগে গত সোমবার (৬ জুলাই) রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে সেখান থেকে আটজনকে আটক করে র্যাব হেফাজতে নেয়া হয়।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার (৭ জুলাই) রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। এতে সোমবার রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে আটক আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ ৯ জনকে পলাতক আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অভিযানের বিষয়ে সারোয়ার আলম বলেন, ‘রিজেন্টকে কোভিড-১৯ হাসপাতালের অনুমতি দেয়ার আগে শর্ত ছিল, এখানে যারা ভর্তি হবেন, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে ফ্রি অব কস্ট (বিনামূল্যে) পরীক্ষা করাবে। আর রিজেন্ট বাসায় বাসায় গিয়ে ১০ হাজারের বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ২৬৪ জনের আইইডিসিআরসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে টেস্ট করিয়েছে। বাকি নমুনাগুলো টেস্ট না করে ভুয়া রিপোর্ট করেছে। আমরা আইইডিসিআরের রিপোর্ট ক্রস চেক করে দেখেছি, রিজেন্ট এগুলো তাদের পাঠায়নি। ভুয়া রিপোর্টের জন্য ৩ হাজার ৫০০ করে টাকা নিয়েছে। আমরা দেখলাম, এ পর্যন্ত সে ৩ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়গুলো চেয়ারম্যান নিজে ডিল করেছে, অন্যান্য কয়েকজন কর্মীও ছিল।’
অন্যদিকে, মঙ্গলবার ভর্তি থাকা রোগীদের স্থানান্তরের পর সিলগালা করে দেয়া হয়েছে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুরের হাসপাতাল শাখা।
তিনি বলেন, ‘এর আগে সোমবার রাতেই মো. সাহেদের মালিকানাধীন হাসপাতাল থেকে অননুমোদিত র্যাপিড টেস্টিং কিট ও একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ওই গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখে ধুলো দিতেই ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদফরের স্টিকার ব্যবহার করতেন।’
অন্যদিকে রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের কার্যক্রম ‘অবিলম্বে বন্ধের’ নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
জেইউ/এফআর