ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৩:০১ এএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৪

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিলের রায় আজ সোমবার। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখেন। এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৯ মে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন অান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামান ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা শাখার অাল-বদর প্রধান। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। চলতি বছরের ৫ জুন কামারুজ্জামানের মামলার অাপিল শুনানি শুরু হয়।

ট্রাইব্যুনালে সাত অভিযোগ, পাঁচটি প্রমাণিত: ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে। এর মধ্যে সোহাগপুর ‘বিধবাপল্লি’তে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের দায়ে (তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ) কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বদিউজ্জামান ও দারাসহ ছয়জনকে হত্যার (প্রথম ও সপ্তম অভিযোগ) দায়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ ছাড়া একাত্তরে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় যাবজ্জীবন ও ১০ বছরের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।

কামারুজ্জামান ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক: ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, একাত্তরের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম -এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ময়মনসিংহের মুসলিম ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করছেন ‘আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক’ কামারুজ্জামান।

আসামিপক্ষ পত্রিকাটির ওই প্রতিবেদনের তথ্য খণ্ডন করতে পারেনি। তারা প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে পারেনি। পাশাপাশি, ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সংগ্রামকে জামায়াতের দলীয় মুখপত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ জন্য সাক্ষ্য হিসেবে ওই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। এ ছাড়া অধ্যাপক আবু সাইয়িদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা: যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ শীর্ষক বই ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রকাশিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’ শীর্ষক বইয়েও কামারুজ্জামানকে ‘আল-বদরের প্রধান সংগঠক’ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে।

এ ছাড়া ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শকের স্বাক্ষরিত তালিকাভুক্ত দালালদের একটি নথিতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (তালিকায় ২৮৭ নম্বর) একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর আলবদর হিসেবে ধরা পড়েন এবং তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সময় আসামির গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা আসামিপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী ও কামারুজ্জামানের বড় ভাই স্বীকার করেছেন।

একাত্তরের ৩১ ডিসেম্বরের দৈনিক আজাদ , দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদনেও দেখা যায়, ওই সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন। এসব নথিপত্র এটাই প্রমাণ করে, তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনী গঠন, সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রভৃতি বিষয় সমন্বয় করতেন।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগসমূহ:
প্রথম অভিযোগ (বদিউজ্জামান হত্যা): একাত্তরের ২৯ জুন শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রাম থেকে মো. বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন ও পরদিন গুলি করে হত্যা করা হয়। এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, আলবদরদের সশস্ত্র একটি দল বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে, যাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে হত্যা করা। অপহরণের ঘটনাটি কামারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন আলবদরের সবাই জানত।

প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল বলেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের দলটি কূটকৌশলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে এবং আহম্মেদনগর ক্যাম্পে সেনাদের কাছে হস্তান্তর করে, যার পরিণতি এই আসামি ভালো করেই জানতেন। জেনেশুনে এ কাজ করার মাধ্যমে তিনি হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহ জুগিয়েছেন, উসকানি দিয়েছেন ও সহায়তা করেছেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ (সৈয়দ আবদুল হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণ): আসামি ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।

রায়ে বলা হয়, হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের ঘটনাটি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং ওই ঘটনা আসামির পূর্ণ সহযোগিতায় ও জ্ঞাতসারে হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ (সোহাগপুরে নির্বিচারে হত্যা): একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনারা সম্মিলিতভাবে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ও নারী ধর্ষণ করে।

রায়ে বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার তিন নারীর সাক্ষ্যে ওই অপরাধের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। কামারুজ্জামানের কর্মকাণ্ড, আচরণ ও প্রভাবের মাত্রা—সবকিছু মিলিয়ে এ ঘটনায় তাঁর অংশগ্রহণকেই প্রতিষ্ঠা করে।

আলবদর নেতা কামারুজ্জামান এখানে ‘উপদেষ্টা’র ভূমিকা পালন করেন এবং তিনি পুরো ঘটনা জানতেন। সোহাগপুরে দলগতভাবে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও নির্বিচার যৌন হামলার দায় নেতৃত্বস্থানীয় কামারুজ্জামানের ওপর পড়ে। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ (মোস্তফা হত্যা): রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় ও পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফাকে অপহরণ করে সুরেন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মোহন মুন্সির ‘স্যারের হাত এখন সই হইছে, এখন সাহস হইছে, বন্দুক চালাইতে পারে’—এ বক্তব্য গোলাম মোস্তফা হত্যায় কামারুজ্জামানের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

পঞ্চম অভিযোগ (আহম্মেদনগর ক্যাম্পে হত্যা): ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটি প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ক্যাম্পে বন্দি ১১ জনের মধ্যে তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, বাকি আটজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে, ঘটনার দিন কামারুজ্জামানের নির্দেশে চারজন বন্দিকে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ৭ ও ১৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যে এ অভিযোগ প্রমাণিত হয় না।

ষষ্ঠ অভিযোগ (টুনু হত্যা): টুনু হত্যার জন্য কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটিও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী বলেছেন, আসামি ময়মনসিংহের জেলা কাউন্সিল ডাকবাংলোয় স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে যাতায়াত করতেন এবং রাতের বেলা বিভিন্ন অভিযানে যেতেন। টুনুকে ওই আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে হত্যার অভিযোগ প্রমাণের জন্য এ বক্তব্য যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া অনির্দিষ্ট কারও কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে ওই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন, যার ওপর ভিত্তি করে কাউকে অপরাধের জন্য দায়ী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

সপ্তম অভিযোগ (দারাসহ ছয়জনকে হত্যা): রাষ্ট্রপক্ষের নবম সাক্ষীর সাক্ষ্য অনুসারে, দারা ও তাঁর বাবা টেপা মিয়াকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। প্রথম সাক্ষী বলেছেন, ওই ক্যাম্পে ২০-৩০; কখনো ৪০ জন আলবদর সদস্য অবস্থান করতেন। নবম সাক্ষী বলেছেন, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা প্রায়ই ওই ক্যাম্পসংলগ্ন নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে লোকজনকে হত্যা করতেন। রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী বলেছেন, কামারুজ্জামানকে প্রায়ই আগ্নেয়াস্ত্রসহ তাঁর ক্যাম্প কার্যালয়ে দেখা যেত।

এসব সাক্ষ্যের বিশ্লেষণ করে রায়ে বলা হয়, ওই ক্যাম্পে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পদ্ধতি কামারুজ্জামান পরিচালনা করতেন। ওই পদ্ধতির মধ্যেই দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যা করা হয়।

রায়ে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপরও বর্তায়। কারণ, অধঃস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাঁদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটা প্রমাণিত যে, অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে দুটি আলবদর ক্যাম্পে বা আলবদর সদস্যদের মাধ্যমে অথবা আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্প থেকে। আলবদর ক্যাম্পগুলোতে বা আলবদর সদস্যদের ওপর কামারুজ্জামানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। আলবদরকে মনে করা হতো পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দল জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, পরামর্শ, উসকানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।

সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উল্লিখিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনাগুলো ঘটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে। ১, ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে উল্লিখিত ঘটনা ঘটে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে, ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যে। শুধু চতুর্থ অভিযোগের ঘটনাকাল ২৫ নভেম্বর।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ ছাড়া বাকি পাঁচটি অভিযোগে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ ও সপ্তম-এই চারটি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা বা সহযোগিতার জন্য এবং দ্বিতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

শাস্তি: শাস্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনাটি চরম হিংস প্রকৃতির ছিল। আসামি তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছেন।

ট্রাইব্যুনাল রায়ে অারও বলেন, ‘আসামি যেভাবে এসব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে সুবিচার হবে না।’ হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি নির্বিচার যৌন নিপীড়ন মানবিকতাবোধকে উৎখাত ও ধ্বংস করেছে, যার দায় আসামিকে নিতে হবে।

অপরাধে অংশগ্রহণের মাত্রা বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, তৃতীয় ও চতুর্থ অপরাধের দায়ে আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া না হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।