বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে বাধা, দিল্লিকে ঢাকার চিঠি
নানা দেন-দরবার শেষে কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালু করতে সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলো খুলে দেয়া হয়। কিন্তু ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য প্রবেশ স্বাভাবিক থাকলেও বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ বন্দর দিয়ে ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে না ভারত।
বিষয়টি দুদেশের মধ্যকার চুক্তির লঙ্ঘণ হিসেবে দেখছে ঢাকা। তবে এ সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে ইতোমধ্যে দিল্লিকে চিঠিও পাঠিয়েছে ঢাকা। পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে নৌ সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত আছি। আপাতত এটুকু বলতে পারি যে, বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশের বাধা দূর করতে কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা চলছে। আশা করছি, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।’
সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বেশ কিছুদিন দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্য বন্ধ থাকায় দুই দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে প্রথমে উদ্যোগ নেয় ভারত। দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও উন্নয়নে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের বাণিজ্য, পররাষ্ট্র এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠক হয়।
এ ছাড়া একাধিক ফোনকল ও ভার্চুয়াল বৈঠকে বাণিজ্য স্বাভাবিক করার বিষয়ে জোর দিতে থাকে ভারত। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য নিয়ে বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জুন থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি শুরু করে ভারত। তবে বাংলাদেশি পণ্য দেশটিতে প্রবেশে বাধা পেতে থাকে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে বাধা পাওয়া নিয়ে ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয়েছে। ভারতীয় পণ্য আমদানির মতো বাংলাদেশি পণ্য রফতানিও যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে বিষেয়ে দিল্লিকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে সমস্যার সমাধান হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দুপক্ষই বাণিজ্য চালু করতে একমত হয়েছি। দুদেশের চুক্তি অনুযায়ী সমানভাবে পণ্য আমদানি ও রফতানি চলবে। কিন্তু কেন বাংলাদেশ পণ্য রফতানি করতে পারছে না, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ’
তিনি বলেন, ‘এর আগে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার রাজি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের বাধায় কিছুদিন দুদেশের স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রাখতে হয়। তখন বাংলাদেশি সীমানায় পণ্য দিতে আসা ট্রাক চালকদের বাধ্যতামূলক ১৪দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখার কথা বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এরপর দুদেশের জিরো পয়েন্টে পণ্য নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই স্থানে সব পণ্য নামিয়ে আবার বাংলাদেশি ট্রাকে তোলার মতো পরিস্থিতি না থাকায় এই সিদ্ধান্ত কাজে দেয়নি।’
‘বাধ্য হয়ে তখন আমরা রেলপথে পণ্য পরিবহনের কথা ভাবি। এরপর নানা আলোচনার মাধ্যমে আবারও বন্দর খোলার সিদ্ধান্ত আসে। কিন্তু এরপরেও বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে না পারা দুঃখজনক। আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে,’- বলেন ড. মোমেন।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। করোনার এ পরিস্থিতিতে পণ্য আসাটাও জরুরি। এজন্য রফতানির বিষয়ে আমরা কিছুটা ধৈর্য ধারণ করছি। তবে পরিস্থিতি না বদলালে শক্ত অবস্থানে যেতে সময় লাগবে না।
পশ্চিবঙ্গের ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানায়, যারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে ব্যবসা করেন তারাও বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। কিন্তু এখনই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে তারা কিছু বলতে বা কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না।
তবে স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানিতে জড়িত বাংলাদেশি সিঅ্যান্ডএফের (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) সদস্যরা জানান, মঙ্গলবার (৩০ জুন) এ নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে যে, আমরা পণ্য রফতানি না করতে পারলে ভারতীয় পণ্য আমদানিও করব না। এ ছাড়া প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমদানি-রফতানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাধায় বাণিজ্য বন্ধ থাকলে এ নিয়ে মমতার সরকারকে কড়া ভাষায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা না দিতে হুঁশিয়ার করে দিল্লি।
করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই দেশ বৈঠক করে জানায় যে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পেট্রাপোল-বেনাপোল, গেদে-দর্শনা, রোহানপুর-শিংহাবাদ এবং রাধিকাপুর-বিড়ল এ চারটি রেল সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে। আর এ চারটি দিয়েই পণ্য পরিবহনের অনুমুতি রয়েছে। ফলে দুই দেশের পণ্য পরিবহনে এই চারটি রুট ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে করে রেলওয়ের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে সমন্বিত চেকপোস্ট এবং স্থল বন্দরগুলোতে চাপ কমানোর বিষয়ে ঐকমত্য হন বৈঠকে যোগ দেয়া কর্মকর্তারা।
রেলওয়ের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করলে তা অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ের পাশাপাশি ব্যবহারবান্ধব ও দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য নিরাপদ বলেও মত দেন তারা। এর বাইরে এ পুরো প্রক্রিয়াতে মানুষ কম লাগবে, ফলে এতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ কম হবে।
এ ছাড়া রেলওয়ের পাশাপাশি করোনার কারণে দুই দেশের বন্ধ করে দেয়া অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনে নৌ প্রটোকল রুটে আবারও নৌযান চলাচলে সম্মত হয় দুই দেশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সূত্র ধরে সরবরাহ ব্যবস্থা, পণ্যের চলাচলের সঙ্গে নিত্যপণ্যের আনা-নেয়া, সমন্বিত চেকপোস্টে ও স্থল বন্দরগুলোতে বাণিজ্য সুবিধা, শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিনিয়োগ সহজীকরণ নিয়ে আলোচনা হয়।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশিদার বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য ১০ দশমিক ২৫ বিলয়ন ছাড়িয়েছে।
জেপি/জেডএ