হাসপাতালে শয্যা খালি তবুও ১৫ দিনে বাসায় মৃত্যু ১৬৯ জনের
রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য পৃথক ডেডিকেটেড হাসপাতাল চালু থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকেই হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এ মুহূর্তে হাসপাতালের শয্যা খালি নেই, রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে কিন্তু আইসিইউর সব শয্যা পরিপূর্ণ ইত্যাদি নানা অজুহাতে রোগী ভর্তি না করে বাসায় থেকে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিয়ে বিদায় দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে ৩০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে বাসায় কিংবা পথে।
খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত হেলথ বুলেটিন এ ৩০ শতাংশ রোগীর বাসাতেই মৃত্যুর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দুই সপ্তাহে (১৪-২৬ জুন) রাজধানীসহ সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত সর্বমোট ৫৬৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। তাদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩৯৬ অর্থাৎ ৭০ শতাংশ মারা যান।অবশিষ্ট ১৬৯ জন (৩০ শতাংশের) মারা যান বাসায়। এ ১৬৯ জনের মধ্যে অবশ্য সাত জনকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা ভাইরাস নিয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে শুক্রবার (২৬ জুন)অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, ঢাকা মহানগরীতে করোনার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে ১৬টি এবং ঢাকা জেলায় একটি। ঢাকা মহানগরীতে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা সংখ্যা ছয় হাজার ৭৭৩টি এবং আইসিইউ শয্যা ১৮০টি। সাধারণ শয্যায় ভর্তি আছেন দুই হাজার ৩৭৫ এবং আইসিইউতে ভর্তি আছেন ৯৭ করোনা রোগী। রাজধানীসহ সব বিভাগ মিলে সাধারণ শয্যা সংখ্যা ১৪ হাজার ৬১০টি এবং মোট আইসিইউ ৩৭৯টি। রাজধানীসহ দেশে করোনা হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছেন চার হাজার ৬৯১ এবং আইসিইউ শয্যায় ভর্তি আছে ১৮৩ জন।
রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সব হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও কেন হাসপাতালে রোগীরা ভর্তি হতে পারছে না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনাটি ঘোষণা দেয়ার মধ্যেই রয়ে গেছে। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল নির্দেশনা মানছে না। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই নিরাশ হয়ে বাসায় যাচ্ছেন। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কারণে বাসাতেই তারা মারা যাচ্ছেন।
যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই বয়স্ক এবং তারা বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিতে আগে থেকেই ভুগছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে হাসপাতালে গেলে হয়তো ভর্তিকৃত অন্যান্য কারণে রোগীদের মাধ্যমে নিজেও সংক্রমিত হয়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে এমনটা মনে করে অনেকেই বাসায় থাকাকেই শ্রেয় মনে করছেন। ফলে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে যাওয়ার সময়টুকুও তারা পাচ্ছেন না।
তারা বলেন, কোনো পরীক্ষার পর পজেটিভ শনাক্ত হলে তাকে আইসোলেশন নিতে হবে এবং তার সংস্পর্শে যারা ছিল তাদের কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। যাদের শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধি রয়েছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, বাসায় মৃত্যুর দুটি কারণ হতে পারে। একটি হাসপাতালে গিয়ে হয়তো ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ফিরে এসে বাসায় চিকিৎসা গ্রহণের ফলে আকস্মিকভাবে শ্বাসকষ্টসহ জটিলতা দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যু ঘটছে। এছাড়া অনেকেই আছেন বয়সে প্রবীণ এবং বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, এমন অনেকে হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তারা বাসায় থাকছেন এবং হঠাৎ করে তাদের শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সেই শারীরিক জটিলতা সারিয়ে তুলতে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা কিংবা আইসিইউতে ভর্তির প্রয়োজন হলেও আইসিইউ শয্যা স্বল্পতার কারণে ভর্তি হতে পারছে না।
তিনি বলেন, যেকোনো কারণে রোগীর বাসায় মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাসায় মৃত্যু মাধ্যমে চিকিৎসাসেবায় দুর্বলতা ফুটে উঠে। রোগীদের অবশ্যই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
১৪-২৬ জুন হাসপাতাল, বাসা ও পথে মারা যাওয়াদের পরিসংখ্যান
২৬ জুন মারা যাওয়া ৪০ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩১ ও বাসায় ৯ জন।
২৫ জুন মারা যাওয়া ৩৯ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৮ ও বাড়িতে ১১ জন।
২৪ জুন মারা যাওয়া ৩৭ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩৪ ও বাসায় তিনজন।
২৩ জুন মারা যাওয়া ৪৩ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩০, বাসায় ১২জন এবং হাসপাতালে মৃত অবস্থায় একজনকে আনা হয়।
২২ জুন মারা যাওয়া ৩৮ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৫ ও বাসায় ১২ এবং হাসপাতালে মৃত অবস্থায় একজনকে আনা হয়।
২১ জুন মারা যাওয়া ৩৮ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩৩ ও বাসায় ছয়জন।
২০ জুন মারা যাওয়া ৩৭ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৭ ও বাসায় ১০ জন।
১৯ জুন মারা যাওয়া ৪৫ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩১ ও বাসায় ১১ জন।
১৮ জুন মারা যাওয়া ৩৮ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৪ ও বাসায় ১৫ জন।
১৭ জুন মারা যাওয়া ৪৩ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৭ ও বাসায় ১৫ এবং হাসপাতালে মৃত অবস্থায় দুজনকে আনা হয়।
১৬ জুন মারা যাওয়া ৫৩ জনের মধ্যে হাসপাতালে ৩৪ জন, বাসায় ১৮ এবং হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয় একজনকে।
১৫ জুন মারা যাওয়া ৩৮ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২৫ ও বাসায় ১১ এবং পাতালে মৃত অবস্থায় দুজনকে আনা হয়।
১৪ জুন মারা যাওয়া ৩২ জনের মধ্যে হাসপাতালে ২০ ও বাসায় ১১ এবং হাসপাতালের মৃত অবস্থায় একজনকে আনা হয়।
এমইউ/এএইচ