করোনাকালে সর্বধর্মীয় দাফন-সৎকারে হাজির কোয়ান্টাম
কখনও মুসলিম দাফন, কখনও সনাতন ধর্মাম্বলীদের সৎকার, কখনও বৌদ্ধদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কখনওবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোককে সমাধিস্থ করা- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত কিংবা সন্দেহে মৃতদের শেষবিদায় জানাতে হাজির হয়ে যাচ্ছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবী দল। যার যার ধর্মমতে শেষবারের মতো সম্মানের সাথে সম্পন্ন করছেন মরদেহের শেষকৃত্য। গত ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে সর্ব ধর্মীয় মানুষের শেষযাত্রার সেবায় চলছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এ দাফনসেবা।
কোভিড-১৯ দাফন কার্যক্রমের সমন্বয়ক ছালেহ আহমেদ বলেন, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান- সব ধর্মের জন্যই আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। নিজ নিজ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে আমরা দাফন বা সৎকার সম্পন্ন করছি। সারাদেশেই সুসংগঠিতভাবে সেবাদানে নিয়োজিত আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দল। এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ ও সাসপেক্টেড সাত শতাধিক মরদেহের শেষকৃত্যে জড়িত ছিল আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দল। ১৮ জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৭০২ জনের মরদেহ দাফন-কাফন, সৎকার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে কোয়ান্টাম। এর মধ্যে মুসলিম দাফন ও কাফনে ৫৮৫ জন, সনাতন ১০৬ জন, বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ৯ জন এবং খ্রিস্টান ধর্মের ২ জনের শেষবিদায়ে পাশে ছিল কোয়ান্টাম।
ছালেহ আহমেদ বলেন, ধর্মীয় বিধান মেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী দাফন সম্পন্ন করে যাচ্ছি আমরা। মুসলিমদের যথাযথ ধর্মীয় বিধান মেনে গোসল-অজুসহ কাফনের কাপড় থেকে শুরু করে জানাজা পড়িয়ে যথাযথ নিয়মে কবরস্থ করানো হয়। মুসলিম ছাড়াও সনাতন ধর্মালম্বীদের জন্য রয়েছে আমাদের দক্ষ সনাতন দল। খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এছাড়া নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নারী দল।
জানা গেছে, পাবনার দক্ষিণ রাঘবপুরে গত ১১ জুন মৃত্যুবরণ করেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জেমস সুব্রত গোস্বামী। খ্রিস্টীয় রীতিনীতি মেনেই তাকে কবরস্থ করে কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবক দল। পরিবারের কয়েকজনের উপস্থিতিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী জলশুদ্ধি, দেহশুদ্ধি, আত্মাশুদ্ধি, চিতাপূর্বক মন্ত্র কিংবা আত্মার প্রশান্তির জন্য শান্তিমন্ত্র উচ্চারণপূর্বক ধূপ বা চন্দন কাঠের ব্যবহারের মধ্যদিয়ে দাহপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। সৎকারকাজে থাকে প্রশিক্ষিত ব্রাহ্মণের উপস্থিতি। কখনও কখনও পরিবারের কেউ উপস্থিতি না থাকলে নিজেরাই মুখাগ্নি করেন কোয়ান্টাম সনাতন দলের স্বেচ্ছাসেবকরা। একইভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রীতি মেনে দাহপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবক দল।
করোনার এই সময়ে সারাদেশকে ২৩টি জোনে ভাগ করে চলছে কোয়ান্টামের দাফনসেবা। রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, যশোর, বগুড়া, রংপুর, পাবনাসহ দেশের যেকোনো প্রান্তের জন্য প্রস্তুত রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। প্রয়োজনে এক জেলা থেকে ওজু-গোসল ও কাফনের কাপড় পরিয়ে সমন্বয় করে অন্য জেলায় দাফনকাজ সম্পন্ন করছেন কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ছালেহ আহমেদ বলেন, শেষকৃত্যে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দল মৃতের জন্য পূর্ণ মমতা নিয়ে আন্তরিক প্রার্থনা করেন। পরিবারের স্বজনদের উপস্থিতি কম বা না থাকলেও সেখানে পরিবারের একজন হয়েই মৃতকে শেষ সম্মান জানাই আমরা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই দিন-রাতের যেকোনো সময়ের জন্য প্রস্তুত আমাদের পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের শেষবিদায় জানাতে সকলের দোয়া ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত সেবা দিয়ে যেতে চাই।
প্রসঙ্গত, করোনার এই সময়ে একটি দাফন প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩০ রকমের উপকরণ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম। দাফনকাজে সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় অ্যালকোহলসহ কয়েক ধরনের জীবাণুনাশক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী এ দাফন কার্যক্রম চলছে। কার্যক্রমের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, ফেসশিল্ড, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, হেভি গ্লাভস, নেককভার, মরদেহের কাফনের কাপড়, মরদেহ বহনের জন্য বিশেষ বডিব্যাগসহ সুরক্ষার জন্যে কয়েক ধরনের জীবাণুনাশক- পুরোটাই কোয়ান্টামের স্ব-অর্থায়নে স্বেচ্ছাসেবায় পরিচালিত হচ্ছে। দাফন বা সৎকার শেষে সুরক্ষার স্বার্থে কর্মীদের পরিধেয় পোশাকসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কবরস্থান বা শ্মশানে তাৎক্ষণিক পুড়িয়ে ফেলা হয়।
কোয়ান্টাম স্বেচ্ছাসেবক দলের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ অ্যাডভোকেট, কেউবা সাংবাদিক, কেউবা শিক্ষার্থী। দিনে বা রাতে যেকোনো সময় ডাক পড়লেই নানা পেশার এই স্বেচ্ছাসেবক দল হাজির হয়ে যান হাসপাতাল বা মৃতের বাসাবাড়িতে। যথাযথ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মমতা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে মৃতের আপনজন হয়েই শেষবিদায়ের সঙ্গী হন তারা।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সাল থেকে বেওয়ারিশ লাশসহ মৃতের সম্মানজনক শেষবিদায় জানাতে কাজ করছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। গত ২৭ মার্চ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মানবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা কোভিড-১৯ দাফন কার্যক্রম শুরু করেন।
এইচএস/বিএ/এমএস