চট্টগ্রামে প্রথম মাসে ৫৩, পরের মাসেই আক্রান্ত ২১৪৫ জন
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের প্রায় একমাস পরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু সংক্রমণ শুরুর প্রথম মাসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দ্বিতীয় মাসে চট্টগ্রামে করোনার বিস্ফোরণ ঘটে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা এখন চট্টগ্রাম। অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রায় উন্মুক্ত থাকার কারণে চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের বিস্তার দ্রুত ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, ঈদের ছুটি শেষে মানুষ নগরে ফিরলে এ পরিস্থিতির আরও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়। চট্টগ্রামে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। নমুনা পরীক্ষা শুরুর এক মাসের মাথায় ২৬ তারিখ এপ্রিল মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৩ জনে। তবে গত একমাসে বন্দরনগরীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দ্রুতগতিতে।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ মে) একদিনেই ২১৫ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ১৮২ জন চট্টগ্রাম নগরের এবং ৩৩ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
জেলার সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৮ মে চট্টগ্রামে মোট ৬০২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে বিআইটিআইডিতে ২০৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩৮ জন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ল্যাবে ১০০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩৬ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাবে ২৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩৮ জনের করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়। এছাড়া কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে ৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে চট্টগ্রামের তিনজনের করোনা শনাক্ত হয়।’
বন্দরনগরীর অবস্থা ভয়াবহ
গত ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়ায় ৬৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই ব্যক্তি তার ওমরাফেরত মেয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হন বলে ধারণা করা হয়। পরে ৫ এপ্রিল দ্বিতীয় করোনা রোগী শনাক্ত হন ওই ব্যক্তির ২৫ বছর বয়সী ছেলে। এর পরে এক-দুই করে নগরে করোনার পরিস্থিতি অবনতি হতে শুরু করে। তবে গত ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানাগুলো চালুর সঙ্গে সঙ্গে নগরের অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। এর পরে ধারণার চেয়ে দ্রুত গতিতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২০০ জন। এর মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরেই সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৪১ জন। যা মোট রোগীর প্রায় ৮০ শতাংশ।
প্রথমদিকে নগরের প্রবেশমুখ সিটি গেট, আকবরশাহ ও পাহাড়তলী এলাকাকে ঘিরে করোনার বিস্তার ঘটলেও দ্বিতীয় মাসে সংক্রমিত হয়েছেন নগরের প্রায় সব এলাকার মানুষ। ইপিজেড-বন্দর বা চকবাজারের মতো জনবহুল এলাকায় যেমন করোনার বিস্তার ঘটেছে, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল চাঁন্দগাও বা মোহরার মতো এলাকাও বাদ যায়নি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্তজেলা ও নগরের অভ্যন্তরে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল থাকায় চট্টগ্রামে করোনার সংক্রমণ অতিদ্রুত ছড়িয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়ক দিয়ে পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহন হচ্ছে। মাইক্রোবাস ও গাড়িও চলছে। এতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকজন চট্টগ্রামে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন। এ কারণে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম।’
কেড়ে নিল ৬১ প্রাণ
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে ৬১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে জানান, ঈদের আগ পর্যন্ত (২৪ মে) চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক শিশু, ৩৬ জন পুরুষ ও ১৬ নারী। এদের মধ্যে মহনগর এলাকার ৪৪ জন, উপজেলাগুলোতে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। ৬০ বছরের বেশি বয়সে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন ৮৭ জন ব্যক্তিদের মধ্যে ২২ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। ৫১ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মহানগরের পাহাড়তলীতে করোনায় সর্বোচ্চ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নগরের আকবরশাহ এলাকায় ৪, ডাবলমুরিং থানা এলাকায় ৩, দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে ৩, চকবাজারে ১, খুলশী ১, বাকলিয়া ১, সুগন্ধা ১, মোহরা ২, লালখান বাজার ১, কোতোয়ালী ৩, বন্দর ২, এনায়েত বাজার ১, পার্ক ভিউ ১, ইপিজেড ১, মাদারবাড়ি ১, পাঁচলাইশ ১, পতেঙ্গা ১, সদরঘাট ১, ঈদগায় ১ জন এবং কদমতলি এলাকায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া উপজেলা গুলোর মধ্যে পটিয়ায় সর্বোচ্চ ৩ জনসহ লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও ফটিকছড়িতে ১ জন করে করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
আইসোলেশনে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২০ জনের বেশি নারী-পুরুষ। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো করোনা শনাক্তের আগেই অধিকাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অন্তত ২০ জনের মৃত্যুর পর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত যুবকরা
বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে যুবক ও মধ্য বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ২৭২ জনই ৩১ থেকে ৪১ বছরের মধ্যকার বয়সী যুবক। যা মোট আক্রান্ত রোগীর ২৮ শতাংশ।
এছাড়া শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩১ জন, ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৬৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ২২৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২৭২ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬৭ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১২৪ জন, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ৮৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
আবু আজাদ/এমএফ/পিআর