অতিরিক্ত সচিবের মৃত্যু নিয়ে কুর্মিটোলার চিকিৎসকের আবেগী স্ট্যাটাস
গত ৯ মে কিডনির জটিলতায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। তার মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ সরকারি ‘টেলিসেবা ৩৩৩’র একজন চিকিৎসক। বাবার মৃত্যুর দিনই তিনি অভিযোগ করেন, সুচিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন গৌতম আইচ সরকার। তাকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতাল ঘুরেও কোনো সহায়তা পাননি।
‘আইসিইউ বেড না পেয়ে চিকিৎসকের বাবার মৃত্যু’ শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় ঘটনাটি। ঘটনার দিন ও পরদিন কোনো কথা না বললেও ১১ মে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান শাহজাদ হোসেন মাসুম।
এতে তিনি লিখেছেন-
“ব্যক্তিগত কারণে কিছুটা স্ট্রেসড সময় পার করছি। কথা বলার ইচ্ছা কমে গেছে। তাছাড়া আগে থেকেই অভিযোগের উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ তা অর্থহীন। কোনো লাভ হয় না। সবাই সবকিছু নিজের মতই বিশ্বাস করেন। তবু কয়েকটা কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ আমি নিজেই সরাসরি ব্যাপারটায় জড়িত।
দুদিন থেকে একটি খবর নেটে ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই আমাকে ইনবক্স করেছেন, নিজের টাইমলাইনে বন্ধুরাও শেয়ার করছেন। খবরটি সর্বতোভাবে সত্যি হলে আসলেই সেটা খুবই আপত্তিজনক।
সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি দীর্ঘদিন থেকে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন, জটিলতা দেখা দিলে তিনি এইসময়ে চেষ্টা করেও হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে পারেননি। সর্বশেষ কুর্মিটোলায় ভর্তি হন এবং আইসিইউতে না নেওয়ার কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর কন্যা একজন সরকারি চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের পিতা এবং একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মৃত্যুতে আমি আন্তরিকভাবে সমব্যথী। জীবনে এইটুকু অর্জন সহজে তিনি করতে পারেননি। রাষ্ট্রের কাছে তার প্রত্যাশা এবং প্রাপ্যতা অন্যদের থেকে বেশি।
অন্য হাসপাতালগুলোর কথা আমি জানি না। আমি কুর্মিটোলার ব্যাপারে দুয়েকটি কথা বলতে চাই। গভীর রাতে তিনি কুর্মিটোলা হাসপাতালে পজিটিভ রোগী হিসাবে ভর্তি হন। কেবিন খালি না থাকায় তাঁকে প্রথমে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেই রাত্রেই পরিচালক মহোদয় প্রাধিকারের কারণে প্রথম খালি কেবিনে তাঁকে শিফট করার ব্যাবস্থা করেন। পরদিন সন্ধ্যায় তাঁর কন্যার কাছ থেকে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোভিড টেস্ট করা হয়নি। পরদিন সকালে তাঁর স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়। সেদিন ছিল শুক্রবার।
সেদিন সন্ধ্যায় রাউন্ডের সময় মেডিসিন কনসালট্যান্ট সিদ্ধান্ত নেন তাঁকে আইসিইউতে শিফট করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর কন্যাকে এটি জানান। এবং আইসিইউতে কল পাঠান। একই সময় ওয়ার্ড থেকে একজন সাধারণ রোগীর জন্য আইসিইউতে কল আসে যার অবস্থা খুব খারাপ। আইসিইউতে তখন আর মাত্র একটি বেড খালি আছে। আইসিইউর এম ও আমাকে দুটি রোগী সম্পর্কেই বিস্তারিত জানান। আমি সিদ্ধান্ত নেই ওয়ার্ডের রোগীকে নেওয়ার জন্য এবং প্রথম বেড খালি হওয়ার সাথে সাথে কেবিনের রোগীকে নেওয়ার জন্য। পাঁচ মিনিটের মাঝেই এম ও আমাকে আবার ফোন করে জানান, স্যার মেডিসিনের কনসালট্যান্ট জানিয়েছেন, কেবিনের রোগীকেই নিতে, উনি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমি পরিস্থিতি বিবেচনা করি এবং মেডিসিনের কনসালট্যান্টকে জানাই, সিদ্ধান্ত তাঁকে নেয়ার জন্য, যে কোনো একজনকে সিলেক্ট করার জন্য। আমরা যে কোনো একজনকেই নেবো। আমরা অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর তিনি জানান, কেবিনের রোগী আইসিইউ তে শিফট হতে রাজি নন। তারা টেস্টের রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ আইসিইউর সব রোগী পজিটিভ। রোগীর কন্যা রিস্কবন্ড সই করেছেন (যা রোগীর ফাইলে এখনো সংরক্ষিত আছে)। পরদিন সকালে পরিচালক মহোদয় তাঁকে ডায়ালাইসিসে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। কিন্তু সেখানেও সব রোগী পজিটিভ হবার কারণে তাঁরা অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। দুপুরে তাঁর অবস্থার অবনতি হয় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেইসময় পরিচালক মহোদয় নিজেও কেবিন প্রিমিসিসে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের আরও কিছু অভিযোগ আছে, সেসব নিয়ে কিছু বলবো না, আগে অন্যখানে বলেছি।
প্রতিটি মৃত্যুই চিকিৎসকের পরাজয়, একটি পারিবারিক, মানবিক বিপর্যয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান সময়ে গভীরভাবে বিপর্যস্ত। আমার কাছে মনে হয় চলমান এই বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্য আমাদের একটা জিনিসেরই প্রয়োজন ছিল, একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা। যা তৈরির দায়িত্ব ডাক্তারদের হাতে কখনোই ছিল না। এই বিষয়ে আর কিছু বলবো না। শুধু একটা জিনিস জানুন। এখন পর্যন্ত আমাদের কয়েকটি কোভিড এবং কয়েকটি নন-কোভিড হাসপাতাল আছে। শুরু থেকেই মধ্যবর্তী রোগীরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে মারা যাচ্ছেন। এই রোগীর ক্ষেত্রেও শুরুতে তাই হয়েছে। আজও পর্যন্ত সাসপেক্টেড রোগীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আপনারা দোষ ডাক্তারদের দিয়েই ফেইসবুকের পরবর্তী ইভেন্টে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। সমস্যাটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
যান, অসুবিধা নেই। শুনেছি রাস্তায় রাস্তায় জ্যাম। বাজার জমজমাট। গতকাল আড়ংয়ের মেসেজ পেলাম। জেনে রাখুন কোভিড হাসপাতালগুলো লড়াইয়ের শেষ সীমায় আছে। আমাদের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়রা নিজেদের ইনফেক্টেড হওয়া থামাতে পারছেন না। প্রতিটা হাসপাতাল রোগীর ভারের শেষ সীমায়। গতকালের নতুন ইনফেকশানের সংখ্যা দেখেছেন। আপনারাই বলেন এই সংখ্যাটা শুধু একটা ফ্র্যাকশান। এরপর আর গালিতে হবে না। লাঠি নিয়ে এসে ডাক্তার-নার্স পিটিয়ে যাবেন। তবু যদি আর দশ দিন পর হাসপাতালগুলো আপনাদের চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতায় থাকে। সারাজীবন শুধু অন্যের দোষ ধরে গেছেন, নাগরিক হিসাবে নিজের দায়িত্ব পালনে চূড়ান্ত অনাগ্রহ। বাঙালি লাইনে দাঁড়ালে মনে করে ইজ্জত শেষ। ফোন পেয়ে কেউ তাঁকে স্যার স্যার করে লাইন থেকে বের করে নিয়ে বিশেষ সার্ভিস দেবে, এই অ্যাটিচুড নিয়ে চলা বাঙালির আজকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া সারাজীবনের সবচেয়ে বড় অপমান। এই অপমানের রিপার্কাশান খুব নীরব হবে না। আমরা যারা সরকারি হাসপাতালে কাজ করি এইসব আমরা জানি।
তবু সবার মঙ্গল কামনা করি। এনেসথেশিয়া যাঁর কাছে শিখেছি, জীবনের নানা প্রয়োজনীয় দর্শন যাঁর কাছ থেকে নিয়েছি সেই প্রিয়জন কোভিড পজিটিভ। তিনি প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় ভাই, প্রিয় স্বজন। আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য প্রার্থনা করি। জানি না কখন নিজেরও এই সময় আসে। ভয় কি শুধু এই দেশে ডাক্তারদেরই!!
তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম অবশ্য বলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতিতে উনি ঠিকমতো ডায়ালাইসিস করাতে পারেননি, তাই তার মৃত্যু হয়েছে।”
এআর/এইচএ/এমকেএইচ