ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ডাক্তার-নার্সদের উদ্দেশ্যে এক রোগী ‘যেন দেবতা নেমে এসেছে ধরায়’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৮:৪৮ এএম, ১১ মে ২০২০

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া ডাক্তার-নার্স ও অন্য কর্মীদের দেবতার সঙ্গে তুলনা করেছেন এক রোগী। তিনি লিখেছেন, চোখের সামনে দেখা এসব ডাক্তার-নার্স নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন; তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এসব করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, আনন্দ বিলিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের মাঝে। তাদের এই ঋণ কি আসলে শোধ হবে?

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের স্ত্রী কবি শারমিন সুলতানা রীনা এসব কথা বলেন। হুমায়ুন কবীর মারা যাওয়ার পর তিনি ও তার ছেলে করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

রোববার ফেসবুকে ‘দেবদর্শন’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, গল্পটা এভাবেও শুরু হলে হয়তো ভালো হতো-
একটি রুমে দুটো বেড আর পাশাপাশি দুটো মানুষ গল্প ও খুনসুটিতে কেটে যেতে পারতো আরও কিছু বর্ণিল সময়। আমাদের আরেকটা নতুন গল্পের সূচনা হতে পারতো এখান থেকে; কিন্তু হলো না কিছুই। ভাগ্যের অজানা পরিহাসে সব উল্টে পাল্টে গেল এক মুহূর্তে আমার বাঁঁচার উপাদান। আমার হাসব্যান্ড সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন; যাকে আমি সবসময় ‘সাংবাদিক’ বলে সম্মোধন করতাম। যে একাকী চলে গেছে নির্জন মাটির ঘরে। তার ঠিক দুদিন পর ছেলেকে নিয়ে এসে উঠেছি হাসপাতালে; পাশাপাশি দুটো সিটের কেবিনে। নিদারুণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আটদিন আইসিউতে কাটানোর পর ফিরে এলাম জেনারেল বেডে। আমি ও আমার ছেলে আবীর দুই মা-বেটা একটা কেবিনে আছি।

পুরো বিশ্ব এখন কোভিড-১৯ করোনার মরণছোবলের কাছে হার মেনে যাচ্ছে। যুগে যুগে মানুষই সব বাধা-বিপত্তি দূর করে অন্ধকার থেকে ছিনিয়ে এনেছে সোনালী আলোর বিকিরণ। মানুষ আবার জয়ী হবে, জয়ী তাকে হতেই হবে। জয় শব্দটা মানুষের আরেকটি প্রতিরূপ।

আমি যে হাসপাতালে আছি সেটা উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতাল। দেশের একমাত্র প্রাইভেট করোনা হাসপাতাল এটি। আজীবনই আমার চোখে ঘুম কম। আমার খোকন সাহেব তার কাজ সেরে বাসায় আসতো রাত দুটো বা তিনটেয়। আসলে আমরা খেয়ে দেয়ে গল্প করতাম। চা খেতাম। গভীর রাতে আমাদের একসাথে কখনও পাশাপাশি কখনও মুখোমুখি বসে চা পানের তুমুল নেশা ছিল দুজনেরই। রাতে আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। আগে জেগে থাকতাম সুখে; আর এখন একটা শূন্যতা ঘিরে ঘিরে থাকে, যার কোনো বর্ণনা হয় না। হয়তোবা এটাই আমার অযাচিত নিয়তি।

রাতে একের পর এক করোনারোগী আসে। তরুণ ডাক্তার-নার্সগুলো তাদের অক্লান্ত সেবা দিয়ে যায়। সবার পরনে সাদা পিপিই। তাদের দেখলে এক একজনকে মনে হয়- সফেদ দেবতা নেমে এসেছেন ধরায়; মর্ত্যবাসীদের উদ্ধারে। এখানে আসার পর রোগ সম্বন্ধে আমার ভয় কেটে গেছে। কেটে গেছে হাসপাতাল সম্পর্কে অনীহা। এই রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতিটা সদস্যদের আচরণে যে ভালোবাসা আর মুগ্ধতা পেলাম, তাদের এ অবদান কখনও ভুলব না।

এই হাসপাতালের যিনি চেয়ারম্যান জনাব শাহেদ চৌধুরীর সাথে আমার কথা হয়নি তবে আমার প্রিয়জনের সাথে নিয়মিত আমাদের চিকিৎসা নিয়ে যোগাযোগ করছেন। এখানকার ডাইরেক্টর মিজান ভাই আমাকে বোনের ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন। সর্বক্ষণ আমার ও ছেলের খোঁজ নিচ্ছেন। আছেন গণসংযোগ কর্মকর্তা শিবলি ভাই। ডা. ওয়াহিদ, যিনি নিয়ম করে দেখে যাচ্ছেন প্রতিদিন। আসলে বলতে চেয়েছিলাম ডাক্তারদের গল্প কিন্তু শব্দরাও হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।

rinas

চোখের সামনে দেখা এসব ডাক্তার-নার্স নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন; তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ডা. নুসরাত, ডা. মণি, ডা. ইমতিয়াজসহ আরও অনেকেই এখানে আছেন আছেন নার্স, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এসব করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, আনন্দ বিলিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের মাঝে। তাদের এই ঋণ কি আসলে শোধ হবে?

ঢাকা শহরে বড় বড় হাসপাতালে করোনার কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। আর করোনা নিয়ে মানুষের মনেও রয়েছে প্রচুর ভয়। করোনারোগীর তিন ফুটের দূরত্বে ভাইরাস আসতে পারে না। আর মানুষের মৃত্যুর পর তিন ঘণ্টায় ভাইরাসের কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যায়।

সুতরাং লাশের শরীর থেকে তিন ঘণ্টা পর ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়। করোনা আক্রান্ত রোগীর কোনো দোষ নয় এটা। এটা বিশ্বজুড়ে এক মহামারি। যেকোনো সময় যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার প্রথম দিকে বুঝতে পারলে তা বাসার চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীকে তাচ্ছিল্য করা হয় বলে এরা জনসমক্ষে মুখ খোলে না ঘাতকব্যাধিকে যন্ত্রণায় পোষে। সামাজিক লজ্জায় এরা আরও ছোট হতে থাকে তখন তাদের মানসিক অবস্থার দ্রুত পতন ঘটে, যার পরিণাম মৃত্য।

গতকালও দেখলাম এক উপসচিবের মৃত্যু। কিডনি জটিলতায়ও করোনা মনে করে তাকে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা হলো না।আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করে মানবিক হতে হবে। আমরা শারীরিভাবে একজন একজনের থেকে দূরে থাকব এই দূরে থাকাটাই আমাদের আরও কাছে টানবে। আমরা ভুলে যাই সব ভেদাভেদ এখন কেউ কাউকে দোষ দিয়ে পিছিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে আর ঢলে না পড়ি। সরকার, প্রশাসনসহ সবার কাজে সহোযোগিতা করি। বিশ্বের এই লগডাউনের বিপদে আমরা সবাই সবার পাশে দাঁড়াই।

যেভাবে লিখতে চেয়েছিলাম সেভাবে পারিনি। অনুভূতি কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। আমার এ ঘোর বিপদে যারা আমার পাশে আছেন তাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। তাদের সবার জন্য আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সুস্থ হয়ে যেন বাসায় যেতে পারি- আপনারা আমার ও আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।

অবশেষে দেবতার রূপে প্রতিমুহূর্তে এখন যাদের দেখছি তাঁদের জন্য কবি শেখ ফজলুল করিমের এই কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে-

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।

উল্লেখ্য, গত ২৮ এপ্রিল রাত ১০টায় রাজধানীর উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সাংবাদিক খোকন। এরপর থেকে স্ত্রী রীনা ও তাদের এক সন্তানের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।

তারা বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে রীনাকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। পরে তাদের সাধারণ বেডে স্থানান্তর করা হয়।

এইচএস/বিএ/জেআইএম