ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘পিঠমোড়া করে শুধু কাজল নয়, আমাদের পুরো পরিবারকে বেঁধেছে’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৯:৩৩ এএম, ০৬ মে ২০২০

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে পিঠমোড়া করে বেঁধে থানায় এবং পরে জেলহাজতে নেয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার ছেলে মনোরম পলক। তিনি বলেছেন, পিঠমোড়া করে তো শুধু কাজলকে বাঁধেনি, আমাদের পুরো পরিবারটিকে একসঙ্গে বেঁধেছে। একটার পর একটা মামলা দিয়ে বাঁধছে। আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচজন মানুষ। মাথাপ্রতি একটি করে মামলা।

মঙ্গলবার (৫ মে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এসব কথা বলেন ছেলে মনোরম পলক।

গত ৮ মার্চ হাতিরপুলে নিজ কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। নিখোঁজের ৫৪ দিন পর ৩ মে তার সন্ধান পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করেছে বিজিবি। তবে পিঠমোড়া দিয়ে সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরানো ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনেকে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করে হাতকড়ার ছবিটি দিয়েছেন।

মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্টে সাংবাদিক কাজলের ছেলে মনোরম পলক লিখেছেন, ‘৫৩ দিন পরে ৫৪ ধারার মামলা। পিঠমোড়া করে তো শুধু কাজলকে বাঁধেনি আমাদের পুরো পরিবারটিকে বেঁধেছে একসাথে। একটার পর একটা মামলা দিয়ে বাঁধছে। আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচজন মানুষ। মাথাপ্রতি একটি করে মামলা। তিনটি Digital security act মামলা দিয়েছে। ধরেন, একটি আমার বাবার মাথা গুনে, একটি আমার মা জুলিয়া ফেরদৌসকে, একটি আমি মনোরম পলকের মাথা ভেবে। এই গেল তিনটি মামলার হিসাব। তারপর ধরেন, আমার ১১ বছরের বেয়াড়া ছোট বোনের মাথা কাউন্ট করে দেশ উপহার দিল ৫৪ ধারার মামলা।’ ‘এরপর আমাদের সাথে থাকেন আমার নানাভাই। নানাভাইকে মাথায় রেখে বিজিবি দিল অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা। এই একটি মাত্র মামলায় আমার বাবা এবং আপনাদের কাজলের জামিন হয়েছে। নানাভাই আপাতত দুধ ভাত।’

মনোরম আরও লিখেছেন, “প্রথম ৫৩টা দিন আমরা ছিলাম শোকে কাতর তবুও আমরা ছিলাম প্রচণ্ড রকমের আশাবাদী। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, ‘কাইট্যা ভাসিয়ে দিয়েছে কখন’, অনেকেই বলছেন ‘ফিরে আর পাবেন না’, আবার অনেকেই বলছেন, ‘সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকব’। আমরা দুই বিপরীতমুখী টানে আমরা ৫টা প্রাণী মাঝখানে সিধা দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাষ্ট্র বলেন বা দেশ বলেন অথবা সিস্টেম, আমাদেরকে নিজ ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার অংশে কোনঠাসা করে রেখেছিল। আমরা সেখানে ৫টা প্রাণী প্রতিদিন পালা করে কেঁদেছি। মনে হয়েছিল আমরা ৫ জন একটা চিকন সরু তারের উপর দুদোল্যমান।”

‘কতবার যে সেই তার থেকে নিচে পরেছি। রক্তাক্ত মুখটা নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি সেই তারে আপনাদের অনেকের বাড়ানো হাতটি ধরে। টিভি মিডিয়ার ব্যক্তিত্ব, শিল্পনির্দেশক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-এ রকম বহুজনের কথা এখন মনে পড়ছে, যাদের বাড়ানো হাতে আমরা শক্তি পেয়েছি।’

“এখন আমাদের ‘মে ইন যশোর ডেইজ’ শুরু। আমাদের আর আমাদের চার দেয়ালের ঠুনকো নিরাপত্তার মধ্যে পুরে রাখেনি আপনাদের রাষ্ট্র, আমাদেরকে টেনেহিঁচড়ে যশোরে নিয়ে গেছেন। আমাদের গায়ের চামড়া সরু তার থেকে পরতে পরতে, তদুর্যপরি অদৃশ্য চাবুকের একটার পর একটা আঘাতে করেই ছিলে নিয়েছে। এখন সিস্টেম দিয়ে আমাদের ছোলা গতরে লবণ মাখা হচ্ছে। আমাদের পুরো পরিবারটিকে পিঠে হাতমোড়া দিয়ে বেঁধেছে। আমাদের মুখ বাঁধা লাল গামছায়। আমাদের পায়ে টাকা নামক অভাবের শিকল দিয়ে বাঁধবে বলে তাদের নীলনকশা তৈরি”-লিখেছেন মনোরম।

‘আমরা কোর্ট করব, কাচারি করব। আমাদের খালি গতর থেকে মাংসের দলা আদালতের সিঁড়িতে এবং জেল ফটকের সামনে স্লো মোশনে খসে খসে পড়বে। তাও আমরা এক দণ্ডের জন্য থামব না। সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের পায়ের গোড়ালিতে কেলাস পড়বে, পড়ুক। আমাদের বাজার করতে একবার ভাবতে হবে, ভাবব। আমাদের প্রতিদিনকার মতো যতটুকু ঘুমুতে পারি, ঘুমুতে যাওয়ার আগে কল্পনা করে নিতে পারি বাবা আমাদের থেকে ঠিক জানা দূরত্বে জেলখানায় পাশ ফিরে আমাদের মতোই ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।’

‘আমাদের কথা জড়িয়ে যাবে, যাক। আমি মনোরম পলকের মনোবলের প্রাচীরে চিড় ধরাতে নানারকম চেষ্টা করবে, করুক। সেই ফাটলে আমি আমাদের ছাপা প্রিন্টের চাদর দিয়ে টান টান করে বাঁধব। চাদরটা যখন সরাতে যাব তখন চাদরে থাকবে আমাদের অনুভূতির নানা রকম রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। আমাদেরকে চামড়াবিহীন অনেক কুৎসিত লাগবে। আমরা আমাদের সেই কুৎসিত পরিবেশনা নিয়ে সিস্টেমের মুখোমুখি দাঁড়াব। আশা করছি, আপনারা ছাপা প্রিন্টার ফুলগুলিকে দেখবেন। রক্তের দাগ আপনাদের জন্য নয় বলে রাখছি।’

‘কিন্তু দিন শেষে আমরাও তো মানুষ। আমাদের প্রচুর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যখন আমাদের চামড়া তোলা হচ্ছিল। আর এখন একটা মধ্যবিত্ত শরীরে যতুটুকু মাংস থাকে তার থেকে খাবলার পর খাবলা তুলে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দলার পর দলা এখানে সেখানে। আমাদের মাংসপিণ্ড আপনারা এখন পড়ে থাকতে দেখবেন।’

‘আপনাদের থেকে লুকাব না। সত্যি বলতে কী, আমাদেরও আপনাদের মতোই কষ্ট হয় একটু কম আর বেশি। মনে হয় কেউ আমাদের হৃদপিণ্ডে ক্রমাগত সাঁড়াশি চালাচ্ছে। কিন্তু এও জানবেন, সেই ধারালো সাঁড়াশি আপনাদের ভালোবাসার কাছে নস্যি।’

‘বাবাকে যখন দেখি পিঠে পিছমোড়া করে বাঁধা হ্যান্ডকাফে, কলিজাটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অপমানে লজ্জায় চোখের পানি আগুন হয়ে বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে আপনাতেই। দিনশেষে যখন আপনাদের কাছে আসি তখন দেখতে পাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সব্যসাচী হাজরা আমার বাবার পিঠে আড়মোড়া করে বাঁধা ছবির অনুরূপে একটি পোস্টার করে কাজলের মুক্তি চেয়েছেন; দিনের আলোর অপমান এবং লজ্জা রাতের মিশকালো অন্ধকারে সেই পোস্টারখানা জ্বলজ্বল করে আমাকে আমার যাবতীয় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।’

“তারপর ধরেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ‘পিঠমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামেরাশিল্পী’ হেডলাইন আমার বাবাকে ফটোসাংবাদিক থেকে এক মুহূর্তেই ক্যামেরাশিল্পী করে তার পরিধির সীমা বাড়িয়েছেন। আমার বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব প্রতিদিনই বাড়ছে আপনাদের দেওয়া মলমে এবং অ্যান্টিবায়োটিকে। আপনাদের কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত মূলবোধ আর সম্মানের সংজ্ঞা শিখছি। আমাদের চামড়াবিহীন গতরের সর্বদা বিদ্যমান জ্বালাকে মুহূর্মুহূ প্রশান্তি দিচ্ছে আপনাদের দেওয়া মলম এবং অ্যান্টিবায়োটিক।”

সাংবাদিক কাজলের ছেলে লিখেছেন, ‘সবাই হয়তো মলম এবং অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারবে না, কিন্তু আমরা বাঙালি আমরা সবাই টোটকা দিতে পারি যেকোনো সময়। আপনাদের মধ্যে যারা শিল্পী, লেখক, সমাজকর্মী, ডিজাইনার এবং যত ক্রিয়েটিভ মাধ্যমের আছেন তাদেরকে বলছি, আপনারা আমাদেরকে মলম এবং অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ দিতে থাকেন। আমাদের লজ্জা থেকে বাঁচান। আমাদের আগুনপুড়া শরীরে আপনাদের মলম খুবই দরকার। আমাদেরকে [email protected] ঠিকানায়, পেইজের ইনবক্সে বিভিন্ন পোস্টার, লেখা, গান, কবিতা, ভিডিও বার্তা পাঠাতে থাকুন। এই সময় আপনাদের থেকে এর বেশি আশা করছি না।’

‘জেনে রাখবেন, আপনাদের মনোরম পলক আপনাদের প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে এবং ভালোবাসে। আপনাদের মলম, অ্যান্টিবায়োটিক এবং টোটকার অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি
আপনাদের
মনোরম পলক’

এইচএস/এসআর/পিআর