ভুট্টা কেনার কেউ নেই, বিপাকে চাষীরা
দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষীরা ভুট্টা চাষ করে বিপাকে পড়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে পাইকার না আসায় তারা ভুট্টা বিক্রি করতে পারছেন না। তাই ভুট্টা নেয়ার কোনো লোক নেই। গ্রামাঞ্চল থেকে যেসব ফড়িয়া ভুট্টা কিনে মহাজনের ঘরে দিতেন, তারাও এখন ভুট্টা কিনছেন না।
তারা বলছেন, করোনার কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ। এক জায়গা থেকে ভুট্টা কিনে অন্য জায়গায় নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া মহাজনেরা ভুট্টা নিয়ে মুরগির খাদ্য ও মাছের খাদ্য তৈরির যেসব মিলে বিক্রি করবে সেগুলো এখন বন্ধ। ফলে এখন ভুট্টা কিনছে না তারা।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরপাড়া গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ। গতবার ধানের দাম কম পাওয়ায় এবার তিনি ৯ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন। এই ভুট্টা বিক্রি করে দিনমজুরদের টাকা দেবেন। এছাড়া পরবর্তী আবাদের জন্য সার কিনবেন তিনি। সার-ঔষধের দোকানে পুরানো বাকি আছে, সেসব পরিশোধ করবেন। কিন্তু ভুট্টা বিক্রি করতে পারছেন না।
আকিমুদ্দিন শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ভুট্টা বিক্রি করে দোকানের বাকি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া পরবর্তী ফসল সবজি চাষ ও পাট চাষের জন্য জমি তৈরি করতে হবে। এই ভুট্টা বিক্রি করেই ধান কাটার মজুরি দিতে হবে। কিন্তু ভুট্টা কেনার বেপারী নেই। দু-একজন মজুত করার জন্য যারা কিনছেন, তারা দাম বলে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা মন। এ দামে ভুট্টা বিক্রি করলে আমাদের ক্ষতি হবে।
একই উপজেলার উল্লাপাড়া গ্রামের হেলাল খাঁ বলেন, এবার ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করে বিপদে পড়েছি। লকডাউনের এক সপ্তাহ আগে ভুট্টার দাম ছিল ৮০০ টাকা মন। এখন তার অর্ধেকের কম দাম বলে বেপারীরা। এছাড়া মজুত করার জন্য দু-চারজন যারা ভুট্টা কিনে চাতালে শুকাতে যাচ্ছেন পুলিশ তাদের বাঁধা দিচ্ছে। পুলিশ বলছে, চাতালে যারা কাজ করে তারা সামাজিক দূরত্ব মানতে পারছে না। এভাবে উত্তরাঞ্চলের চাষীরা ভুট্টা বিক্রি না করতে পেরে পরবর্তী ফসলে হাত দিতে পারছে না। কৃষকরা এখন বেকার বসে আছেন।
তিনি বলেন, এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) ভুট্টা চাষ করতে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ পড়ে। সাধারণত এক বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ মন ভুট্টা হয়।
বগুড়ার ভুট্টা ব্যবসায়ী আকবর আলী জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর ভুট্টার মৌসুমে আমরা হাজার হাজার মন ভুট্টা ক্রয় করি। ভুট্টা কিনে যেসব মিলে মুরগির খাবার, মাছের খাবার ও পশুখাদ্য তৈার করে সেখান পাঠাই। এবার তাদের কোনো অর্ডার নেই। ফোন করেছিলাম কয়েকজনের কাছে। তারা বলছেন, মিল আপাতত বন্ধ। খুললে আমরা ভুট্টার অর্ডার দেব। তখন সরবরাহ করবেন।
তিনি আরও বলেন, ভুট্টা বিক্রি না করতে পেরে কৃষকরা খুব কষ্টে আছে। তারা এক ফসল বিক্রি করে আরেক ফসল আবাদ করেন। তবে এটা শুধু বগুড়া জেলার ঘটনা নয়। গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, নিলফামারি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর, রাজশাহী সব জেলায় একই অবস্থা। আমরা ভুট্টা কেনার জন্য কোথাও যাচ্ছি না।
উত্তরাঞ্চলের ভুট্টা চাষীদের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জি ই ডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, দেশে বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলছে। এর মধ্যেও সামাজিক দূরুত্ব বজায় রেখে কৃষি কাজ, বাজার ব্যবস্থা, পরিবহন, ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে হবে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবন বাঁচাতে গুরুত্ব দিতে হবে। ভুট্টা, ধান, গম যে ফসলই হোক, কৃষক যেন সে ফসল বিক্রি করতে পারে এ জন্য বাজার কার্যক্রম যতটা সম্ভব অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, এলাকা ভেদে এ ব্যবস্থা চালু রাখা যেতে পারে। যেখানে করোনার উপদ্রপ কম, সেখানে বাজার ব্যবস্থা পরিবহন, বিপণন চালু রাখতে হবে। সবকিছু বন্ধ করলে তো চলবে না। যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কৃষককে চলাফেরা করতে হবে।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক কৃষিপণ্য উৎপাদন, ফলন ও আবাদের ওপর সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইএসডিএ)। এতে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ মৌসুমে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন ও ফলনে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে ধানের পরই দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ আবাদীত শস্য ভুট্টা। ইউএসডিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ মৌসুমে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৪০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হতে পারে, যা আগের মৌসুমের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।
এফএইচ/এমএসএইচ/এমকেএইচ