ভিডিও কনফারেন্সে যা শুনলেন ও নির্দেশনা দিলেন প্রধানমন্ত্রী
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠান থেকে তিনি করোনা নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা, জনসচেতনতা, গরিব দুঃখীদের মাঝে খাদ্য বিতরণ, উৎপাদন অব্যাহত রাখা, পরিবহন সাময়িকভাবে চালু রাখা, নিত্যপণ্যের সরবরাহ রাখা, আগামীর ফসল উৎপাদন বাড়ানো এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিস্তারিত তুলে ধরে নির্দেশনা দেন।
ভিডিও কনফারেন্সে ক্যাবিনেটের সদস্য, মন্ত্রিপরষদ সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মাঠ পর্যায়ে ৬৪ জেলা এবং আটটি বিভাগীয় কার্যালয়ের কমিশনাররা যুক্ত ছিলেন ভিডিও কনফারেন্স। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় মাঠ পর্যায়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই গণভবন থেকে মাদারীপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হন। মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম সূচনা বক্তব্য রাখেন। এছাড়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও একজন নার্সও বক্তব্য রাখেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, সবচেয়ে আগে আক্রান্ত হয়েছিল। এখানে ১০ জন আক্রান্ত ছিলেন। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন এবং ৯ জন ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুনে খুব খুশি হলাম। এখানে যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল আল্লাহর রহমতে সেভাবে কোনো ক্ষতি হয়নি। এরপরে সংযোগ দেয়া হয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনকে। এ সময় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সিভিল সার্জন, সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যাম্পে খাদ্য চিকিৎসা ছাড়াও অন্যান্য কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাইরের কোনো লোক যেন ক্যাম্পে প্রবেশ না করে। আমাদের নিজেদের যারা দেখাশোনা করছেন তারাই সেখানে যথেষ্ট। আর কক্সবাজারে পর্যটক যেন না যায় সে নির্দেশনা দেন তিনি।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসককে সংযোগ দেয়া হলে তার সূচনা বক্তব্যের পর জেলা পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি কর্নেল ফারজানা বক্তব্য রাখেন। গাইবান্ধায় করোনা রোগের অবস্থান তেমন না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সন্তোষ প্রকাশ করেন। গাইবান্ধার পরে সংযোগ দেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা জেলায়।
জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার তার সূচনা বক্তব্য রাখেন। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার সেলুন, সিভিল সার্জন ডাক্তার এ এস এম মারুফ হাসান বক্তব্য রাখেন। তারা চুয়াডাঙ্গা জেলার করোনা পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্মিলিতভাবে কাজ করলে আমরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হবো ইনশাল্লাহ। সংযোগ দেয়া হয় রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হকের কাছে।
হামিদুল হক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেন, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় এক একজনও করোনা রোগী পাওয়া যায়নি। এতে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্বস্ত হন। অনুষ্ঠানে একজন সিভিল সার্জন বক্তব্য রাখেন। এরপরে বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবির খোন্দকারের কাছে সংযোগ দেয়া হয়।
রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, করোনা ভাইরাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, বিভিন্ন ধর্মযাজক ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছি। এছাড়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ওয়ার্ড কমিশনারের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছি।
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা অত্যন্ত সুখবর, যে একটা বিভাগে আটটা জেলায় একজন করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়নি। সচেতনতা সৃষ্টি এবং আপনাদের প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলামকে। এ সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন, পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন ও সশস্ত্র বাহিনীর একজন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন।
তারা বলেন, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা যে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছি মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছে। সবাই ঘরে ঢুকেছে। এ জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী দেশে আসার পরেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক আছে। যারা বিদেশ থেকে এসেছে সবাই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। যে কারণে পরিস্থিতির কোনো অবনতি ঘটেনি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, এটা অত্যন্ত আশার খবর। এ খবর শুনে খুব ভালো লাগছে। এখানকার চা শ্রমিকরা কাজ করে। তারা যেন সুবিধা পায় সেজন্য আপনারা কাজ করবেন।
এরপরের সংযোগ দেয়া হয় বরগুনায়। জেলা প্রসাশক সূচনা বক্তব্য রাখেন। এর পর বক্তব্য দেন বরগুনার সিভিল সার্জন হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে করোনার বিস্তার ঘটেনি। আমরা সবার কাছে দোয়া চাই। এ সময় জেলার দরিদ্র মানুষদের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ভূমিহীনদের ভূমি এবং ঘর করে দিচ্ছি। যারা বেদে সম্প্রদায় তারা তো এখন আর নৌকায় থাকে না। তারা যেন আশ্রয় পায়। সেজন্য তাদের বাড়িঘর করে দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর সংযোগ পেয়ে সূচনা বক্তব্য রাখেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আপনি লালমনিরহাটে কী দেননি সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সবকিছুই দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা যে আমাদের কপালে মঙ্গা নামক যে তিলক ছিল সেটা মুছে দিয়েছেন। এ কথা আমরা কখনও ভুলবো না।
এরপর সংযোগ দেয়া হয় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের প্রথম করোনা রোগী ছিলেন ফয়সাল শেখ। তিনি আজ চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন। এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায় সবাই ফয়সালকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে ফয়সাল শেখকে মাইক দেয়া হলে তিনি বলেন, আমি জার্মানিতে পড়াশোনা করি। আমার দেহে যখন করোনার লক্ষণ দেখা দেয় তখন আমি নিজেই আইসোলেশনে চলে যাই। এরপর একদিন নিজে থেকেই আইইডিসিআর-এ যোগাযোগ করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। এরপরে আমি সেখানে চিকিৎসা নেই এবং তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমার চিকিৎসা করেন। আমার পরিবারের আর সদস্যরা ছিলেন তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখেন। ফলে আমি এবং আমার পরিবার সকলেই এখন সুস্থ আছি।
ফয়সাল সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, নিয়ম কানুন মানার কারণে আমি ভালো আছি। দেশের সবাইকে বলব প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন আপনারা সবাই সে নির্দেশনা মোতাবেক চলবেন। ইনশাল্লাহ আপনারাও ভালো থাকবেন।
তার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি সুস্থ হয়ে উঠেছ। তোমার পরিবারের কাছে ফিরে গেছ। এটা অত্যন্ত খুশির খবর। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি আর কেউ যেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়। এই অনুষ্ঠানে ঢাকা সিটি উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, শুধু সিটি করপোরেশন নয় এর বাইরে ও বিভিন্ন সংগঠন সিটি করপোরেশন এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসা দেয়ার জন্য দেশের সব ডাক্তারকে শুভেচ্ছা জানান তিনি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ মানুষের জন্য। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে করোনা ভাইরাসকেও আমরা জয় করতে পারব।
তিনি বলেন, করোনার সঙ্গে মশা এবং ডেঙ্গ যেন যুক্ত না হয়। এজন্য আমাদের আগে থেকেই খেয়াল রাখতে হবে। করোনার সঙ্গে মশা এবং ডেঙ্গু যুক্ত হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য আগে থেকেই সজাগ থাকতে হবে।
এরপরে ভিডিও কনফারেন্সে সংযোগ দেয়া হয় ক্যাবিনেট ডিভিশনে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ভিডিও কনফারেন্সে সচিবালয় প্রান্ত থেকে যুক্ত হন।
এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবও সচিবরা সচিবালয় প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ এবং পিএমও সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া অন্যান্যের মধ্যে গণভবনে উপস্থিত ছিলেন।
এফএইচএস/এএইচ/পিআর