স্বপ্ন উদ্যানে আজ সীমাহীন শূন্যতা
স্বপ্ন উদ্যান। চট্টগ্রামের উঠতি বয়সীদের জন্য স্বপ্নের মতোই। ভোর থেকেই এখানে ভিড় করতে থাকেন নগরবাসী। মধ্যরাতেও থাকে সমান জমজমাট। জামালখান ওয়ার্ডের এই চত্বরটি গত কয়েক বছরে পরিণত হয়েছে নগরবাসীর মিলনস্থলে। পাশেই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব হওয়ায় এখানে আসলে অনেকটা শাহবাগের আমেজ পাওয়া যায়। তবে সেসব আজ অতীত। করোনার থাবায় স্বপ্ন উদ্যানে এখন খেলা করছে সীমাহীন শূন্যতা।
সড়কের পাশের দেয়ালে ম্যুরাল। এতে চোখ রাখলে একঝলকে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। সড়কদ্বীপে সবুজের সমারোহ। রাতে এলইডি বাতির আলোয় ঝলমল করে সড়কদ্বীপের দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। এর পাশের ফুটপাতে বসার সুন্দর ব্যবস্থা। অথচ আজ (শুক্রবার) বিকেলে খাঁ খাঁ করতে থাকা সেই চত্বরে দাঁড়িয়ে মনে হলো এ যেন মরুভূমি। অচেনা কোনো জগৎ!
খালি সড়কে পথ চলতে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখা মিলছে রিকশার। মাঝে মাঝে দু-একটি প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলও খালি সড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। চিরচেনা কোলাহলও নেই। গাড়ির শব্দ নেই, হুঁইশেল নেই, মানুষের হাঁকডাক নেই।
ফুটপাতের সাড়ি সাড়ি আসনগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, যেখানে দুদিন আগেও বসার জায়গা পাওয়া যেত না। দু-একজন এসে বসলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে এসে বসছেন ক্লান্ত দু-একজন রিকশাওয়ালা। বিশ্রাম নিয়েই আবার চলে যাচ্ছেন। অথচ এই জামালখান মোড়ই কিনা চট্টগ্রামে যানজটের অন্যতম কেন্দ্র। দিনে দুবার যানজট নিয়ম হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই!
জামালখান সড়কের পাশে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাসে সংক্রমনের ভয়ে এর সবকটিই এখন বন্ধ। তাইতো সড়কে নেই সেই নির্মল উচ্ছ্বাস। নেই স্কুলগামী কিশোরীর সেই ভুবন মাতানো খিলখিল হাসি। নিস্তব্ধ সড়কে শুধু পুলিশ-সেনাবাহিনীর টহল আর সতর্ক হুঁইশেল।
খাস্তগীর স্কুলসংলগ্ন যাত্রী ছাউনিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রিকশাচালক আছিয়ার (৪০)। জানালেন বাড়ি গাইবান্ধা, শহরের আমতলী বস্তিতে থাকেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও তাকে জীবিকার তাগিদে বের হতে হয়েছে। না হয় বাড়িতে দুই মেয়েকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে তার স্ত্রী আর বৃদ্ধ মাকে।
আছিয়ার বলেন, ‘জুম্মা পইড়া রিশকা (রিকশা) লই বাহির হইছি। এখন পর্যন্ত (বিকেল ৫টা) ১৫০ টাকার ভাড়া মারছি। রাত ১০টার আগে বাসায় যামু না। নাইলে জমিনদারের (বাড়ির মালিক) ট্যাহা দেওন যাইব না। তয় রিশকা মালিক ভালা মানুষ। এখন কিছু কম দিলেও নেয়। বাড়িওয়ালাই মানে না।’
স্বপ্ন উদ্যান পেছনে ফেলে হেঁটে আগাই কাজির দেউড়ি দিকে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। বিএনপি অফিস, লাভলেইন, বৌদ্ধমন্দির পর্যন্ত পুরোটাই ফাঁকা। কাজীর দেউড়ির কাঁচাবাজারেও ক্রেতার আনাগোনা তেমন নেই। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন পথচারীর দেখা মিলেছে। চেরাগী পাহাড় মোড়ে শুধু ওষুধের দোকান কয়েকটা খোলা আছে। মোমিন রোডের দু-একটি মুদির দোকানও খোলা পাওয়া গেল।
এদিকে ঘরবন্দি মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিন পুলিশ। নগরের বিভিন্ন এলাকায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন এমন পরিবারের বাসায় বাজার পৌঁছে দিয়ে সহায়তা করেন তারা। এছাড়া সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে সহাতার হাত বাড়িয়েছেন বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্তারা।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘ঘরে থাকতে নগররবাসীকে অনুরোধ করেছিলাম। তারা অনুরোধ রেখেছেন। কোতোয়ালী থানা এলাকার গরিব বড়লোক সবার পাশে আমরা আছি যেকোনো প্রয়োজনে। অনেকেই সহায়তা চেয়ে ফোন করছেন থানায়। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। কথা দিয়েছিলাম প্রয়োজনে ঘরের বাজারও আমরা দিয়ে আসব। সেই কথাও রেখেছি। আজ আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেইন এলাকা থেকে আফসানা পারভীন (৪০) নামে এক গৃহবধূ সহায়তা চাইলে টিম কোতোয়ালী বাজার পৌঁছে দিয়েছে তার বাসাতেই। ইনশাআল্লাহ একটা লোকও অভুক্ত থাকবে না।’
আবু আজাদ/বিএ