নেতৃত্ব নির্বাচনে স্যার ফজলে হাসান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’- এর চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
‘ব্র্যাকের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিচক্ষণতার সঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন’- গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’-এর নতুন চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
‘ব্র্যাক’-এর নতুন নেতৃত্ব হস্তান্তরের বিষয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সুচিন্তিত মতামত এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেন হোসেন জিল্লুর রহমান। বলেন, ‘ব্র্যাকের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত এমন উদাহরণ দেখা যায় না। এটি মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে অনুকরণীয় একটি বিষয় হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ব্র্যাক এবং ফজলে হাসান আবেদ সমার্থক হলেও দীর্ঘমেয়াদের ভাবনায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে। ‘ব্র্যাংক ব্যাংক’র চেয়ারম্যান করা হয়েছে আহসান হাবিব মুনসুরকে। তিনি অর্থনীতিবিদ। ‘ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল’র চেয়ারম্যান করা হয়েছে আমিরা হককে। তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। বাংলাদেশি নারী। তিনি নিউইয়র্কে থাকেন।
ব্র্যাকের বিভিন্ন বোর্ডগুলোও পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্র্যাক নিয়ে স্যারের নতুন ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটছে, তা বলা যেতেই পারে। আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেয়ার মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রটা পরিষ্কার হয়েছে বলে মনে করি। ম্যানেজমেন্ট ঠিক মতো কাজ করছে কি-না এবং এ নিয়ে যথেষ্ট জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হলো। আমি হয়তো প্রতিনিয়ত ব্র্যাকে বসব না। এমন বোঝাপড়ার মধ্য থেকেই ব্র্যাকে সম্পৃক্ত হওয়া।
ব্র্যাকের যথার্থ উত্তরাধিকার তৈরিতে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সুচিন্তিত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে সে সময় হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ব্র্যাক। যেমন- ব্র্যাক বাংলাদেশ, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল। আবার ব্র্যাক ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্যার হয়তো তার উত্তম পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখতে চান। তিনি সবগুলো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন রিফর্ম করে আলাদা আলাদা ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেয়া হলো।
ব্র্যাকে যোগদান প্রসঙ্গে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ক’বছর আগে ফজলে হাসান আবেদ স্যার আমাকে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের পদে যোগদানের প্রস্তাব করেছিলেন। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব সাহেব ইন্তেকাল করার পর। আমি ঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য ওই পদে যেতে চাইনি। মূলত আমার পক্ষে যোগ দেয়া সম্ভব ছিল না।
এবার স্যার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে হয়তো প্রস্তাব রেখেছেন। স্যারের প্রস্তাব গ্রহণ করতে হয়েছে। তিনি অনুধাবন করেছেন হয়তো, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ঠিক এখনই। অনেক সময় প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানের নতুন কেউ দায়িত্বে আসেন। স্যার হয়তো জীবদ্দশায় এমন একটি অ্যাকশনে যেতে চান, যা তারই নেয়া পরিকল্পনার অংশ।
আমি স্যারের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছিলাম। ব্র্যাক এখন বিশাল এক ক্ষেত্রের নাম। ১৯৭২ সালে যখন প্রতিষ্ঠা পায় সেই প্রতিষ্ঠানের সীমানা আজ অসীম। বাস্তবতাও ভিন্ন। তখন এনজিও-কে একভাবে দেখা হতো, এখন আরেকভাবে দেখা হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতাও অনেক বদলেছে। রাষ্ট্র, এনজিও বা সামাজিক সংগঠনের মধ্যে যে যোগসূত্র তাতেও নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সব মিলে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে এবং সেটা সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই। আবার ব্র্যাকে আলাদা আলাদা দায়িত্বের বিষয়টিও আরেক ধরনের বাস্তবতা তৈরি করেছে। আমি মনে করছি, সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারব।
ব্র্যাকের দায়িত্ব নেয়ার পর নিজের বিশেষ ভাবনার কথাও জানান ‘ব্র্যাক বাংলাদেশ’-র নতুন চেয়ারম্যান। বলেন, প্রথমত, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে সুযোগ দেয়া। দ্বিতীয়ত, গরিব মানুষের মধ্য নানা ধরনের সম্ভাবনা আছে এবং সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা।
ইকোনোমিস্ট’র শেষ সংখ্যায় ব্র্যাক নিয়ে স্টোরি হয়েছে। সেখানে ব্র্যাকের সফলতার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জের কথাও বলা হয়েছে। আমি চ্যালেঞ্জটা-কে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে চাই। একদিনেই সব পরিকল্পনা নেয়া যায় না। সময় ও বাস্তবতাই সব ঠিক করে দেয়। যেমন- আগে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে বৈষম্যের দিকে।
মানসম্মত শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র মানুষের মাঝে মানসম্মত শিক্ষা যেন আরও বড় একটি এজেন্ডা হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এমন আরও এজেন্ডা সামনে এসেছে। যেমন- মানুষের ভোগব্যয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানসম্মত সেবা চায়। তারা যেন প্রতারিত না হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হলো। এ দাবি সবারই। দক্ষ চালক তৈরি করা সময়ের দাবি। এ নিয়ে ব্র্যাকের কার্যক্রম আছে। এ কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করছি। জনশক্তি রফতানি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। বহু মানুষ প্রতারিত হয়েছে। এখানে ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করে মানুষের মাঝে স্বস্তি আনা দরকার। নগরে সেবার পরিধি আরও বাড়ানো দরকার। ব্র্যাক এসব বিষয়ে উদ্যোগ এবং কাজ করছে। আমার ভাবনাগুলো এর সঙ্গে গ্রথিত করতে চাই।
তবে মূল ভাবনা হচ্ছে, ব্র্যাকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই আমার বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি নয়া বাস্তবতার আলোকে সঠিক নির্দেশনা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা। পিপিআরসি’র (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) গবেষণাই মূলত এর আলোকে। সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের জন্যই আমরা জবাবদিহিতার তাগিদ দিয়ে থাকি। ব্র্যাকে সে তাগিদ আরও সুনির্দিষ্টভাবে দেয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি।
বিশেষ করে আমি মনে করি, আমাদের চলার পথে জ্ঞানশক্তি-কে আরও উন্নত করা দরকার।
এমএআর/আরএস