ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘এভাবে আর কারও সন্তান যেন না মরে’

জসীম উদ্দীন | প্রকাশিত: ০৮:৩২ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০১৯

মা লাভলী বেগম গার্মেন্টে চাকরি করে সংসার চালান। শিশু সন্তান রিফাত (৮) পড়ে রাজধানীর রূপনগরে ব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুলে। বুধবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে আকস্মিক এক বিস্ফোরণে সন্তানহারা হন মা লাভলী বেগম। বাবা রোকন মিয়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছেলের মৃত্যুর খবর পেলেও ফেরার পথ ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরতেও রয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক বাধা।

মামা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে মিনতি করি, আর কারও জীবনে যেন এমন বিভীষিকাময় দিন আর না আসে। বাবা বিদেশে, মা শোকে শয্যাশায়ী। নিহত সন্তানের লাশ মর্গ থেকে নেয়ারও লোক নেই। পুরান ঢাকার ব্যবসা ছেড়ে খবর পেয়েই ছুটে আসছি। সকাল থেকে মর্গে অপেক্ষায়। লাশ বুঝে পেলেও অসহায় লাগছে। শেষবারও শিশুসন্তানের মুখটা দেখতে পেল না ওর বাবা। এভাবে কোনো সন্তানের মৃত্যু যেন আর কারও পরিবারে না হয়।’

রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে নিহত ছয় শিশুর মধ্যে রয়েছে রিফাতও।

বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে একে একে ছয় শিশুর মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রিফাতের মরদেহ নিতে এসে এভাবেই জাগো নিউজের কাছে নিজের কষ্টের কথা উপস্থাপন করেন মামা নুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘মিরপুর থানার পাশেই ওই দুর্ঘটনা। থানা পুলিশ যদি আগে থেকে ওয়াকিবহাল থাকত অথবা নজরদারিতে রাখত অথবা সিটি কর্পোরেশনের কোনো নজরদারি থাকত তাহলে আজ এ ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত না। তাজা শিশুপ্রাণ যেত না।’

Rupnagor-Fire

আজ সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় রিয়া মনি (৮), নুপুর (১১), ফারজানা (৭), রিফাত (৮), রমজান (১১) ও রুবেলের (১১)।

দুপুর সোয়া ১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত একে একে ছয় শিশুর মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মরদেহ নিতে আসা স্বজনরা সে সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে রিয়া মনির মামা মোস্তাক আলী বলেন, ‘রিয়ার বাবা মিলন মিয়া পেশায় রাজমিস্ত্রি। নেত্রকোনায় ওদের বাড়ি। থাকত রূপনগর শিয়ালবাড়ীর বস্তিতে। বেলুন কিনতে যাওয়াই ওর কাল হলো।’

রিকশাচালক বাবা নূর ইসলাম ও গৃহিণী মা পারভীন বেগমের শিশুসন্তান রুবেল পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে। তার নানা আব্দুল মোন্নাফ নাতির মরদেহ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মাত্র ১১ বছর বয়সে রুবেলের এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। ওর পেছনে নিম্নবিত্ত এ পরিবারটির কত আশা ছিল! মেধাও বেশ ভালো ছিল। কিন্তু এক বেলুনেই ওর জীবনবায়ু উড়ে গেল। আল্লাহর কাছে হাজারো মিনতি-আর কারও বুক যেন এভাবে খালি আর না হয়।’

বিস্ফোরণে নিহত ফারজানার মামা আব্দুর রহমান বলেন, ‘৭ বছর বয়সী শিশু ফারজানা পড়ছিল ক্লাস ওয়ানে। বাবা আবু তাহের পেশায় রিকশাচালক। মা অন্যের বাসায় কাজ করলেও ফারজানার পড়াশোনাকে উৎসাহিত করত। সবার আশা ছিল ফারজানাকে মানুষের মতো মানুষ করবে। সকল অভাব দূর করবে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! একই দুর্ঘটনায় ওর চাচাতো বোন মরিয়মও আহত হয়েছে।’

নিহত রমজান (১১) কুলিয়ারচর উপজেলার কোনাপাড়ার একটি মাদরাসায় পড়ত রমজান। বাবা একটি চামড়ার জুতার কারখানায় কাজ করেন। মা গ্রামেই থাকেন।

Rupnagor-Fire

চাচা মো. মহররম আলী বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগে বেড়াতে আসে ঢাকায়। কিন্তু এই আসাই যে ওর মরণযাত্রা তা কেন জানত! কীভাবে যে ওর মাকে সান্ত্বনা দেব সেই ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. কে এম মাইনুদ্দিন বলেন, ‘সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে ছয় শিশুই শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। কারও হাত, কারও পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পেটে আঘাতের কারণে নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে যাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে তাদের।’

সোহরওয়ার্দীর মর্গে নিহত শিশুদের মরদেহ নিতে আসা স্বজনদের হাতে দাফনকাজের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ২০ হাজার করে টাকা দেন ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম। একই সময় রূপনগর এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের চৌধুরী নিহত ছয় শিশুর স্বজনদের হাতে ২০ হাজার করে টাকা দেন।

বুধবার বিকেলে মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীত দিকে ১১ নম্বর সড়কে শিয়ালবাড়ী বস্তির পাশে ভ্যানে করে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিলেন একজন বিক্রেতা। অনেকেই ভ্যান ঘিরে এবং আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কেউবা বেলুন কিনছিল। এ সময় হঠাৎ করে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় সাত শিশুর মৃত্যু হয়।

সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদকে (৩০) প্রধান আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। তাকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে ঢামেকে পুলিশি পাহারায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

জেইউ/এসআর/পিআর