ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

এবার এসেনশিয়াল ড্রাগসের ঠিকাদারি বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৪:১১ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অভিনব ঠিকাদারি বাণিজ্যে নেমেছে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)! দেশে সরকারিভাবে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠানটি দুই বছরের বেশি সময় ধরে বেসরকারি একটি ওষুধ কোম্পানি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন বা ওষুধ উৎপাদন করিয়ে নিচ্ছে। পরে ওই ইনজেকশন বা ওষুধই দুই-তিনগুণ বেশি দামে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করছে ইডিসিএল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক খোলা দরপত্রের (ওপেন টেন্ডার) মাধ্যমে যে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও ওষুধ মাত্র ৪ কোটি টাকা খরচ করে কিনতো বর্তমানে ইডিসিএলের কাছ থেকে একই পরিমাণ ওষুধ ১২ কোটি টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।  
জাগো নিউজের নিবিড় অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Protibedon-p-1অনুসন্ধানে আরও জানা যায়- উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ‘সেফালোস্পোরিন’ উৎপাদনের জন্য পৃথক যে প্ল্যান্ট (যন্ত্রপাতি) থাকা অত্যাবশ্যক সেটি ইডিসিএলের নেই। অথচ দেশীয় প্রাইভেট একটি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ‘সেফালোস্পোরিন’ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করিয়ে এনে নিজেদের নামে তা সরকারি হাসপাতালসমুহে বিক্রি করছে।

ইডিসিএলের অতিরিক্ত দামে বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিবায়োটিক ও ওষুধ বিক্রির বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও নীতিবিরুদ্ধ উল্লেখ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইডিসিএলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানসম্মত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদন করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সূলভ মূল্যে সরবারহ করে সীমিত সম্পদের মাধ্যমে অধিকতর চাহিদা মেটানোর সামর্থ অর্জন করা।

অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন তৈরির পৃথক প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের সামর্থ্য গড়ে তোলার পরিবর্তে মধ্যস্বত্বভোগীদের ন্যায় অন্য বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে অধিক দামে বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা করা ইডিসিএলের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতারণার সামিল বলেও মন্তব্য করেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন-২০১৪ অনুসারে বর্তমানে দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫৯২টি। ঢামেক হাসপাতালে বছরে ৮কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ হলে সব সরকারি হাসপাতালে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনের মধ্যে ঢামেক হাসপাতালে ৭ লাখ ২০ হাজার পিস ইনজেকশন সেফট্রিএক্সন (এক গ্রাম), ১ লাখ ৮ হাজার পিস ইনজেকশন সেফটাজেডিম (১ গ্রাম), ট্যাবলেট সেফোরোক্সিম এক্সিটিল (৭৫০ মিলিগ্রাম) এবং ৩ লাখ ৬০ হাজার পিস ট্যাবলেট এজোথ্রোমাইসিন (৫০০ মিলিগ্রাম) এর বার্ষিক চাহিদা রয়েছে।

ঢামেক হাসপাতালের একাধিক পরিচালকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে খোলা দরপত্র পদ্ধতিতে সরাসরি কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি পিস ইনজেকশন সেফট্রিএক্সন (এক গ্রাম) ৩৫ টাকা,  ইনজেকশন সেফটাজেডিম (১ গ্রাম) ৭৭ টাকা, ট্যাবলেট সেফোরোক্সিম এক্সিটিল (৭৫০ মিলিগ্রাম) ৪৮ টাকা এবং ট্যাবলেট এজিথ্রোমাইসিন (৫০০ মিলিগ্রাম) প্রতি পিস ৭ টাকায় ক্রয় করা হতো। সেই একই ইনজেকশন ও ট্যাবলেট বর্তমানে ইডিসিএল-এর কাছ থেকে প্রতি পিস যথাক্রমে ১১৫, ১৫০, ১০০ ও ১৮ টাকা ২৮ পয়সা দামে কেনা হচ্ছে।

medicinনির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ঢামেক হাসপাতাল নন-ইডিসিএল বাবদ প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কেনার জন্য যে খোলা দরপত্র আহ্বান করেছে, সেখানে একগ্রাম ইনজেকশন সেফট্রিএক্সন ২৯ টাকায় সরবরাহের প্রস্তাব জমা পড়েছে।

দামের পার্থক্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বার্ষিক চাহিদা অনুসারে ওষুধ কিনতে আগে মোট ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার প্রয়োজন হলেও বর্তমানে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ৮শ’ টাকা লাগছে।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার ২০১৪ সালে সর্বনিম্ন যে মূল্যে বিভিন্ন ওষুধ কিনেছে তন্মধ্যে ডমিনিকান রিপাবলিক প্রতি পিস ইনজেকশন সেফট্রিএক্সন (এক গ্রাম) ১৬ টাকায় ও ট্যাবলেট এজিথ্রোমাইসিন (৫০০ মিলিগ্রাম) ৭ টাকায়, পেরু প্রতি পিস ইনজেকশন সেফটাজেডিম (১ গ্রাম) ৫০ টাকায় ও ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জ প্রতি ট্যাবলেট সেফোরোক্সিম এক্সিটিল (৫০০গ্রাম) ৩৫ টাকা দামে কিনেছেন। অথচ একটি ইডিসিএল সরকারি হওয়া সত্বেও তার মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি।

সম্প্রতি ঢামেকসহ বিভিন্ন হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে- ইনজেকশনের গায়ে লাল কালিতে ‘বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ: ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ’ লিখা রয়েছে। নিচে সবুজ কালিতে ইনজেকশনের নাম ও পরিমাণ ও তার নিচে ‘ম্যানুফ্যাকচারড ফর এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড অ্যাট পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, টঙ্গী, গাজিপুর’ লেখা দেখতে পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, ইডিসিএল নিজেরা উৎপাদন না করে ঠিকাদারদের মতো অন্যের কাছ থেকে উৎপাদন করিয়ে এনে সরবরাহ করা অবশ্যই নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে উৎপাদন করাতে হলে ইডিসিএল কেন?

ঢামেক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল হক মল্লিক জাগো নিউজকে জানান, তিনি পরিচালক থাকার সময় ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বাজার মূল্যের চেয়ে এক তৃতীয়াংশ মূল্যে ওষুধ কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কোম্পানিগুলোর কম দামে সরবরাহের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশে ঢামেক হাসপাতালের সুনাম রয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করছে এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোম্পানিগুলো বিদেশের বাজারে ওই ওষুধগুলো রফতানি করতে পারতো বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢামেক হাসপাতালের আরেক সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর জেনারেল পদে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে কর্মরত) জানান, ঢামেক হাসপাতালে যোগদানের পরপরই ইডিসিএল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও অন্যান্য ওষুধ কেনার নির্দেশনাযুক্ত চিঠি পান। ইডিসিএল-এর প্রস্তাবিত দাম অনেক বেশি হওয়ায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ ওষুধ কিনতে পারেননি। তার মতে ওপেন টেন্ডার ডেকে ওষুধ ক্রয় করা গেলে রোগীরা অধিক পরিমাণ দামী অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধ বিনামূল্যে সেবনের সুযোগ পাবে।

গত ১০ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবীর জগলুল জানান, সরকারি  হাসপাতালে তাদের সরবরাহকৃত ওষুধের দাম অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দামের চেয়ে বেশি হয়, কিন্তু একই ওষুধ কোম্পানিগুলো বাজারে আরও বেশি দামে বিক্রি করে বলে জানান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওপেন টেন্ডারে ও ইডিসিএলের ইনজেকশন ও ওষুধের তুলনামূলক দামের পার্থক্য:

মোট টাকার পরিমাণ= ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার,       মোট টাকার পরিমাণ=১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ৮শ’।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-১

এমইউ/একে/পিআর