দশম সংসদে কোরাম সংকটে ক্ষতি ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা
>> মোট কোরাম সংকট ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
>> গড় কোরাম সংকট ২৮ মিনিট
>> পুরুষদের চেয়ে নারী এমপিদের উপস্থিতি বেশি
>> আইন প্রণয়নে নারী এমপিদের অংশগ্রহণ কম
দশম জাতীয় সংসদে কোরাম সংকটের কারণে ক্ষতি (ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য) হয়েছে ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৩ টাকা। গত সংসদের প্রথম থেকে ২৩তম অধিবেশনের (জানুয়ারি ২০১৪ থেকে অক্টোবর ২০১৮) ওপর এক গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির এই গবেষণায় বলা হচ্ছে, উল্লিখিত সময়ে কোরাম সংকট ছিল ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট।
বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লখ্য করা হয়েছে, ২৩টি অধিবেশনে গড় কোরাম সংকট ছিল ২৮ মিনিট, যা প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময়ের ১২ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সংসদে পুরুষদের চেয়ে নারী এমপিরা বেশি উপস্থিত থাকলেও আইন প্রণয়নে তাদের অংশগ্রহণ কম।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, টিআইবির উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ।
সংবিধান অনুযায়ী, ন্যূনতম ৬০ জন সদস্য উপস্থিত না থাকলে সংসদের কোরাম হয় না। কোরাম না থাকলে বৈঠক স্থগিত বা মুলতবি করতে হয়। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে, কোরাম-সংকটের জন্য অধিবেশনে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোরাম হওয়ার জন্য তিনি পাঁচ মিনিট ধরে ঘণ্টা বাজানোর নির্দেশ দেবেন। এর মধ্যে কোরাম না হলে অধিবেশন মুলতবি রাখবেন স্পিকার।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ী ৫৯ শতাংশ, আইনজীবী ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ২১ শতাংশ (শিক্ষক/চিকিৎসক/অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্ত/গৃহিণী/পরামর্শক ইত্যাদি)।
সংসদর বিরোধী দল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পার্টির দ্বৈত অবস্থান একদিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের পরিচয় অন্যদিকে সরকারের অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদের অন্তর্ভুক্তি ছিল। এ জন্য নিজেদের বিতর্কিত অবস্থান থেকে পরিচিতির সংকট এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
একটি বিল পাসে ভারতে ১৪১ মিনিট ব্যয়, বাংলাদেশে ৩১ মিনিট
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজেট ব্যতীত অন্যান্য আইনের মোট সময়ের ব্যয় মাত্র ১২ শতাংশ। অথচ ২০১৭-১৮ সালে যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের হার ছিল প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০১৪-১৯ সালে ভারতে ১৬তম লোকসভার এই হার ৩২ শতাংশ।
ওই সময়ে ১৯৩টি সরকারি বিল পাস হয়। এর মধ্যে সংশোধনী বিল ৫১টি। ১৬টি বেসরকারি বিল উত্থাপিত হলেও একটিও পাস হয়নি।
বিল উত্থাপন এবং বিলের ওপর সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীর বক্তব্যসহ একটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩১ মিনিট সময় ব্যয় হয়। আর ভারতের ১৬তম লোকসভায় প্রতিটি বিল পাসে গড়ে প্রায় ১৪১ মিনিট ব্যয়।
রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো আলোচনার জন্য সংসদে উত্থাপন করার সাংবিধানিক বিধান থাকলেও দশম সংসদে এ ধরনের কোনো চর্চা দেখা যায়নি।
শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল ৮২ শতাংশ
প্রতি কার্য দিবসে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। পুরুষ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৬২ শতাংশ। আর নারী সদস্যদের উপস্থিতি ৭১ শতাংশ। সংসদ নেতা শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল ৮২ শতাংশ।
অন্যদিকে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের উপস্থিতি ছিল ৫৯ শতাংশ। অধিবেশনের কোনোটিতে প্রধান বিরোধী দল বা অন্যান্য বিরোধী সদস্য সংসদ বর্জন করেননি। প্রধান বিরোধীদলীয় ও অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা ১৩ বার ওয়াকআউট করেন।
বিরোধী দল সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা, আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিন্তু একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের অংশ হওয়ায় এবং নিজেদের অবস্থান নিয়ে পরিচিতি সংকটের কারণে জোরালো ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়।
অসংসদীয় ভাষা, কটূক্তি, অশ্লীল শব্দ ব্যবহার
গবেষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার- যেমন : বেয়াদব, হারামজাদা, লম্পট, কুলাঙ্গার, বেঈমান, মোনাফেক, রক্তচোষা মহিলা ইত্যাদি ছিল, যা বিধির ২৭০ এর ৬ ব্যত্যয়।
এ ছাড়া অধিবেশন চলাকালীন অধিবেশন কক্ষে সদস্যদের সংসদ কক্ষের ভেতরে বিভিন্নভাবে চলাফেরা, কোনো সদস্যের বক্তব্য চলাকালীন তার নিকটবর্তী আসনের সদস্যরা নিজ আসনে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলা, অধিবেশনে অমনোযোগিতা, মোবাইলে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি দেখা গেছে।
স্পিকারের ভূমিকায় বলা হয়- সংসদ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিয়ম সম্পর্কে সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করলেও সংসদে অসংসদীয় ভাষা, কটূক্তি, অশ্লীল শব্দ ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের নীরবতা লক্ষ্য করা গেছে, যা সংসদের কার্যপ্রণালির লঙ্ঘন।
বিধি অনুযায়ী অধিবেশন চলাকালীন গ্যালারিতে শৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি দেখা গেছে।
প্রতিবেদনে অষ্টম, নবম ও দশম সংসদের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়নে অষ্টম সংসদে (২০০১-২০০৫) ৯ শতাংশ সময় ব্যয়, নবম সংসদে (২০০৯ -২০১৩) ৮ শতাংশ ও দশম সংসদে ১২ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। অষ্টম সংসদে এমপিদের গড় উপস্থিতি ৫৫ শতাংশ ও নবম সংসদে ৬৩ শতাংশ ছিল।
১১টি সুপারিশ
প্রতিবেদনে সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য ১১টি সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে-
>> এমপিদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। যাতে জাতীয় দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট এবং বাজেট ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেয়ার সুযোগ থাকবে।
>> সংসদ সদস্য আচরণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে সংসদ সদস্যদের সংসদের ভেতরে এবং বাইরে আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে নির্দেশনা থাকবে।
>> সংসদের কার্যক্রম এমন হবে, যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত থাকবে।
>> কোনো কমিটিতে কোনো সদস্যের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেলে ওই কমিটি থেকে তার সদস্যপদ বাতিল করতে হবে।
>> সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি বিধি অনুযায়ী কমিটি প্রতি মাসে একটি সভা করতে ব্যর্থ হলে তার ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন এবং কমিটির প্রতিবেদনসহ সংসদের কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
>> ওয়েবসাইটের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। বাৎসরিক সংসদীয় ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করতে হবে।
এইচএস//জেডএ/জেআইএম