স্বাধীনতা না থাকলে আমার বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার কীভাবে
দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক কায়দায় অত্যাচারের গুরুতর অভিযোগ নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। তারা সেই মানুষ, যারা ‘সারাক্ষণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের পেছনে’ লেগেই আছে।
বর্তমানে লন্ডন রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে গণতন্ত্র, ডিসেম্বরের নির্বাচন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি, পদ্মা সেতুতে মাথা কাটা-সংক্রান্ত গুজব, বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা- এরকম নানা ইস্যুতে কথা বলেছেন।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলাদেশে হেফাজতে নির্যাতনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের, যা সব সরকারের আমলেই দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার এটি বন্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন মানসিকতা আমাদের নেই এবং আমরা সেটি করি না। ঘটনাচক্রে কিছু ঘটতে পারে। বরং আপনি যদি গত ১০ বছরে আমাদের অবস্থান দেখেন, আমরা কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনি আমার নিজের কথাই চিন্তা করেন, যখন আমি আমার বাবা-মা সবাইকে হারালাম, গুলি করে মারা হলো। কই আমি তো বিচার পাইনি। খুনিদের বিচার না করে তাদের ইনডেমনিটি দেয়া হলো। অর্থাৎ অপরাধকে প্রশ্রয় দিলেন। উল্টো তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে দেশে অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়েই একটা সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, সেই দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। হেফাজতে মানুষ হত্যা করার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আমার দলের নেতাকর্মীরা।’
কিন্তু নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধে কি করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন ঠিক ওইভাবে হেফাজতে মৃত্যু হয় না। নির্যাতনও সেভাবে করা হয় না।’
তবে আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহে কিছু নিয়ম রয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর বাইরে কিছু করা হয় না।
আওয়ামী সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ঘটনার পর থেকে অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসাংবিধানিক সরকারের সময় যারা বেশি সুযোগ ভোগ করেছে বা ক্ষমতাটা যারা উপভোগ করেছে, তারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক।
তিনি বলেন, ‘একটা শ্রেণি হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু আছে, যারা অসাংবিধানিক সরকার, জরুরি অবস্থা অথবা মার্শাল ল‘ বা মিলিটারি রুলার আসলে তাদের খুব দাম বাড়ে। কাজেই তারা সারাক্ষণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের পেছনে লেগেই আছে।’
সম্প্রতি পুলিশি হেফাজতে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘের একটি কমিটির মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ।
২০ বছর আগে বাংলাদেশ এ সম্পর্কিত একটি কনভেনশনে সই করে। কিন্তু সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে মাত্র ক’দিন আগে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সুপারিশ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যেসব দেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তাদের একটি, কিন্তু এর সুফল সব পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না?
‘অবশ্যই পৌঁছাচ্ছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
‘সে ভাবেই আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের দিকে আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১ ভাগের উপরে ছিল। আজকে সেটা ২১.৪ ভাগে নেমে এসেছে। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে আমরা সেটা অর্জন করতে পেরেছি। মানুষের মাথাপিছু আয় যেখানে ৪০০-৫০০ মার্কিন ডলার ছিল, আজকে সেখানে প্রায় ২ হাজার মার্কিন ডলারে সেটি উঠে এসেছে। প্রবৃদ্ধি আমরা এখন ৮.১ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছি।’
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন বেশ নাজুক অবস্থায় আছে এবং ঋণখেলাপিরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছে না- এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যতটা প্রচার হয় বিষয়টা ততটা নয়।
‘ঋণ নিয়ে সেটা ফেরত না দেয়া- এই কালচারটাও আমাদের এখানে শুরু হয় মিলিটারি ডিক্টেটরদের আমলে। আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছি, আমরা চেষ্টা করেছি, আমরা অনেক টাকা উদ্ধার করেছি। তারপরও কিছু মানুষের প্রবণতা থাকে যে, টাকা নিলে মনে হয় সেটি আর ফেরত দিতে হবে না।’
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মান ও এর চর্চা কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে এখন ৪৪টি প্রাইভেট টেলিভিশন আছে এবং তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে।
‘স্বাধীনতা না থাকলে তারা আমার বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার করছে কীভাবে।’
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং এ নিয়ে যে সমালোচনা রয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখন কোনো কেন্দ্রে গোনার দিক থেকে হয়তো পেয়েছে। কোনো কেন্দ্রে হয়তো হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে মামলা করতে পারে, কোর্টে মামলা করতে পারে। নির্বাচন কমিশনেও মামলা করতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যদি সত্যিই ভোট দিতে না পারতো, তাহলে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ আন্দোলনে নামত এবং আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না।’
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ডেঙ্গু। ডেঙ্গু রোগের জীবাণুর বাহক এডিস মশার বিস্তাররোধে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে।
তবে সিটি কর্পোরেশনগুলো এডিস মশা সম্পর্কে একেবারেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা মশা নিয়ন্ত্রণকে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে- এমন অভিযোগ মানছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংবাদমাধ্যমে ডেঙ্গুবিষয়ক খবর অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, আর সেটাই সমস্যা সৃষ্টি করছে- বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘একটু উচ্চবিত্ত যারা, সেসব জায়গায়ই এর প্রকোপ বেশি। আমাদের সবসময় লক্ষ্য থাকে বস্তি এলাকা, ড্রেন এসব দিকে। মশা মারা কিন্তু নিয়মিত একটা ব্যাপার।’
শুধু সিটি কর্পোরেশনকে দোষ না দিয়ে সব মানুষকে সতর্কতা অবলম্বন করতে আহ্বান জানান তিনি। মশার ওষুধ কেনায় দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মশার ওষুধ কেনার ব্যাপারে টেন্ডার করা হয়। যারা টেন্ডারে উপযুক্ত হয়, তারা কিনে নিয়ে আসে এবং সেগুলো ব্যবহারও হয়। তবে কোন ওষুধ এডিস মশার উপরে কাজ করে, সে ব্যাপারে বিভক্তিকরণ করা হয়নি বা সেই ধরনের সতর্কতা ছিল না।’
তাকে প্রশ্ন করা হয়ে যে, সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং এর সংখ্যা আরও বড় হবে বলে অনেকে মনে করেন। তাই কীভাবে ভবিষ্যতে মশা নিয়ন্ত্রণ আরও সুষ্ঠুভাবে করা যায়?
এর জবাবে তিনি জানান, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং সরকারের পাশাপাশি তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে আহ্বান করা হয়েছে।
‘শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও ঘরের কাছে বা ঘরে কোথাও যদি পানি জমা থাকে এবং সেখানে মশার লার্ভা তৈরি হয়, তবে তাদের জরিমানা করা হবে। মানুষ যদি আগামীর জন্য প্রস্তুত থাকে, তবে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি হবে না বলে মনে করেন তিনি।
পদ্মা সেতুতে মানুষের কাটা মাথা লাগার গুজব এবং এর জেরে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে বেশ কজন মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি গুজবে কান না দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
যারা গুজব ছড়াচ্ছে, এরকম কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
‘পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আপনিই বলুন, আজকের দিনে, পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা ও রক্ত লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। রক্ত আর কাটা মাথা দিয়ে কি সেতু তৈরি হয়? এই গুজবটা যারা ছড়াচ্ছে, অপরাধী তো তারা।’
পদ্মা সেতুর ব্যাপারে শুরু থেকেই একটা চক্রান্ত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
জেডএ/এমএস