উন্নয়নের গল্পে মশার কামড় কেন?
দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মেট্রোরেলের কাজ। রাজধানী ঢাকার উত্তরভাগে গেলেই মাথা উঁচু করে হাতছানি দিচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। এমন স্বপ্নডানা মেলছে ঢাকার বাইরেও। পদ্মা সেতুর সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও এখন আলোকিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। অন্তত ১০টি বড় প্রকল্প বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছেন মন্ত্রী-এমপি’রাও।
অথচ এমন সময়ই মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মানুষ! ডেঙ্গু জ্বরে কাঁপছে গোটা দেশ। বিগত বছরে রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই। রেকর্ডসংখ্যক মানুষ মারা গেল এ বছর। মরছে প্রতিনিয়ত। হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। রয়েছে শিশুরাও।
নগর উন্নয়ন, পরিকল্পনা আর জনদায়ের প্রসঙ্গ নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এবং নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঙ্গে।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান গোটা উন্নয়ন ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘আমরা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আপনি মানুষের জীবন বিপন্ন করে কোনো উন্নয়নের মডেল দাঁড় করাতে পারেন না। রাজধানী ঢাকা ক্রমশই নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে। এখানে বায়ু চলাচল করতে পারে না। পানির ভান্ডারগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হলো। শব্দদূষণ অতিষ্ঠ করে তুলছে মানুষকে। অথচ এমন একটি শহরে মানুষকে ক্রমাগতভাবে প্রবেশ করানো হচ্ছে।’
নগর উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিবও। তিনি বলেন, ‘শুধু টাকার অঙ্কে উন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করলে সর্বনাশ হবেই। সরকার সেটিই করে ফেলেছে। এ উন্নয়ন কোনোভাবেই টেকসই হতে পারে না। মানুষকে নরকে ঠেলে দিয়ে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না।’
মশার প্রাদুর্ভাব প্রসঙ্গে ড. আদিল খান বলেন, ‘সব ধ্বংস করে কংক্রিটের নগর তৈরি করে গোটা রাজধানীকেই মশার খামার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকায় মেট্রোরেল করা হচ্ছে। অথচ বৃষ্টি হলে লোকাল সড়ক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। মশা তো হবেই। জনগণের প্রতি দায় গুরুত্ব পেলে সঠিক পরিকল্পনায় আমরা উন্নয়ন দেখতে পেতাম।’
তিনি বলেন, উন্নয়নের নামে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে ফেলছি। যেখান থেকে মুক্তির উপায় আছে বলে আমার জানা নেই। জানতে পারলাম, একটি পার্ক সংস্কারের জন্য ৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এত লুটপাটের বরাদ্দ! এ টাকা দিয়ে পাঁচটি পার্ক সংস্কার করা যেত। অধিকসংখ্যক মানুষকে সেবা দেয়া যেত। অথচ এসব বরাদ্দের গল্প শুনিয়েই সরকার আরাম পাচ্ছে আর জনগণ সামান্য মশার সঙ্গে যুদ্ধে করে কষ্টটা টের পাচ্ছেন।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ১৪টি কাজ। কিন্তু মশা নিধন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া বাকি কাজগুলো অন্যান্য দফতরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন মেয়ররা। অথচ সেই মশা নিধন আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও ব্যর্থ তারা। সব কিছুই কেন্দ্রীভূত, মেয়ররাই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরও দায় আছে। তাদেরও কাজ করার কথা। মূলত নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণেই জনদায়ের প্রতি তোয়াক্কা করছেন না জনপ্রতিনিধিরা। এতে গোটা সমাজ নিষ্ক্রিয়তার দিকে যাচ্ছে। সামান্য মশার কামড়ে আদরের সন্তান মারা গেলেও প্রতিবাদ করতে মাঠে নামছেন না বাবা-মা। এ নিষ্ক্রিয়তা কাউকেই সুরক্ষা দেবে না।
সরকারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুসারে, ঠিক এক মাস আগে (৪ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৬৭ জন ভর্তি হয়েছিল। তার ঠিক এক মাস পর (৪ আগস্ট) ২৪ ঘণ্টায় মৌসুমের সর্বোচ্চ রেকর্ডসংখ্যক দুই হাজার ৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ৮৬ জনেরও বেশি নারী, পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৮ জন (এপ্রিল ২ জন, জুন তিন ও জুলাইতে ১৩ জন) বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা তিনগুণের বেশি হবে বলে বলা হচ্ছে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসক, আমলা, গৃহবধূ ও শিশুসহ সব বয়সের রোগী প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী মারা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম