চট্টগ্রামের খামারে ছয় লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত
ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে নানা প্রস্তুতি। রাজধানী ঢাকার বাইরে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সে চাহিদা পূরণে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ ভারত থেকেও গরু আমদানি হয়। কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চাহিদার বড় অংশ মেটাচ্ছেন স্থানীয় খামারিরা।
চট্টগ্রামের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রেয়াজুল হক জাগো নিউজকে জানান, প্রতি বছর চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চাহিদা বাড়ছে। এবারও চাহিদা বেড়ে সাত লাখ ২১ হাজারে দাঁড়িয়েছে। যেখানে গত কোরবানিতে এ চাহিদা ছিল সাড়ে ছয় লাখ।
এদিকে পশুর চাহিদা ও দাম বেশি পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেপারিরা আগেভাগেই গরু নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন পশুর হাটে আসতে শুরু করেছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকেও জানানো হয়েছে, চট্টগ্রামে এবার কোরবানি পশুর সংকট হবে না।
এ বিষয়ে রেয়াজুল হক বলেন, সাত লাখ ২১ হাজার কোরবানি পশুর চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রাম নগর ও উপজেলার খামারগুলোতে প্রায় ছয় লাখ ১০ হাজার পশু রয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেড় লাখ পশু নিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশের অপেক্ষায়।
স্থানীয় চাহিদা মেটাবে খামারিরা, শীর্ষে চট্টগ্রামের লাল গরু
বছর পাঁচেক আগেও চট্টগ্রামে কোরবানির অধিকাংশ পশুর চাহিদা মেটাত বাইরের পশু। সারাদেশ থেকে ট্রাকে গরু-ছাগল নিয়ে বেপারিরা নগরের হাটগুলোতে বিক্রি করতেন। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। বছরের এ একটি উৎসবের চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে গরুর খামার। শুধু কোরবানিতে নয়, নগরীতে সারা বছর বিয়ে, মেজবান ও ওরসের চাহিদাও মেটানো হচ্ছে স্থানীয় খামারের গরু দিয়ে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামবাসীর পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে রেড চিটাগাং ক্যাটল বা লাল গরু।
চট্টগ্রাম ছাড়াও গত আড়াই বছরে দেশব্যাপী বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বন্দর নগরীর এ লাল গরুর মাংস। বিশেষ এ চাহিদার কারণে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া অঞ্চলে সাধারণ গৃহস্থ থেকে খামারিরাও লাল গরু লালন করছেন।
বেসরকারি এনজিও লাইভস্টকের কর্মকর্তা বৃষ্টি বড়ূয়া জানান, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায় চন্দনাইশ ও আনোয়ারা উপজেলায় রেড চিটাগাং ক্যাটল বা লাল গরু লালনপালন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। ইতোমধ্যে এ দুই উপজেলায় ১৮৫টি পরিবার লাল গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। এবার কোরবানিতে বিক্রির জন্য প্রস্তুত রয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার বিশুদ্ধ লাল গরু। এছাড়া সংকর প্রজাতির আরও ২০ হাজার লাল গরু কোরবানির বাজরে আসবে।
সাতকানিয়ার পুরানগর এলাকার খামারি আবুল কাশেম বলেন, এবার আমরা দুই ভাই দেশি মিশ্রজাতের ষাঁড় মোটাতাজা করেছি। এর মধ্যে ১০টি লাল ষাঁড় বাকিগুলো বিদেশি। আশা করছি, লাল ষাঁড়গুলোর প্রতিটি এক লাখ ২০ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি করতে পারব।
খামারি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েডসহ বিভিন্ন ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের কারণে মানুষের মধ্যে দেশি জাতের গরু কোরবানি দেয়ার আগ্রহ বেড়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোরবানির বাজারে প্রতিটি লাল গরু অন্যান্য জাতের গরুর চেয়ে ১৫-২০ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়। মূলত চাহিদার কথা মাথায় রেখে স্থানীয়রা লাল গরুর খামার গড়ে তুলেছেন।
হাটহাজারীর উত্তর ফতেয়াবাদের তরুণ খামারি মো. পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, দুবাই থেকে ফিরে কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম। এক বন্ধুর পরামর্শে ১০টা গরু কিনে খামার শুরু করি। এখন এটাই আমার পেশা। সারাবছর কোরবানিকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজা করি। এর বাইরে বিয়ে, মেজবান আর ওরশেও সারাবছর বিপুল চাহিদা থাকে। এখন আর দেশ ছেড়ে যাওয়া কথা কল্পনাও করি না। এবার আমার খামার থেকে ১৫টি উন্নত মানের গরু বাজারে তুলব।
এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইতোমধ্যে বেপারিরা চট্টগ্রামের কোরবানি পশুর হাটে গরু আনতে শুরু করলেও স্থানীয় খামারিরা এখনও তাদের গরু বাজারে তোলেননি। তারা অপেক্ষা করছেন বাজার শুরু হওয়ার। তবে বন্যার কারণে চারণভূমি, অনাবাদি জমি ও চাষের ঘাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পশুখাদ্য নিয়ে সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের খামারিরা। শুকনো খাদ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় ঈদ বাজারে বাইরের গরু বেশি আসলে ক্ষতির মুখে পড়বেন বলেও আশঙ্কা করছেন স্থানীয় খামারিরা।
সারাদেশ থেকে চট্টগ্রামমুখী বেপারিরা
ঈদের এখনও দুই সপ্তাহ বাকি। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন অস্থায়ী পশুর হাটে কোরবানির পশু নিয়ে হাজির হচ্ছেন বেপারিরা। নগরের বিভিন্ন স্থায়ী পশুর হাট ছাড়াও অস্থায়ীভাবে মৌসুমী বেপারিরা মজুত করছেন কোরবানির পশু।
নগরের পশু ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি জাতের গরুর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে নানা জাতের গরু নিয়ে বেপারিরা আসতে শুরু করেছেন। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টি গরুবোঝাই ট্রাক নগরের বিভিন্ন হাটে প্রবেশ করছে। তবে এখনও বেচা-বিক্রি শুরু হয়নি।
গবাদি পশু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নগরের হাটগুলোতে কোরবানির পশু বিক্রির প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ইতোমধ্যে হাটগুলোতে কোরবানির পশু রাখার ব্যবস্থার কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয় খামারিরা ছাড়াও সারাদেশ থেকে বেপারিরা গুরু নিয়ে হাটে আসতে শুরু করেছেন। আশা করছি, চট্টগ্রামে এবার কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না। এবার জেলার ১৫টি উপজেলা ও নগরের অন্তত ১৯৭টি কোরবানির পশুর হাট বসবে।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) সকালে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পশুর হাট সাগরিকা হাটে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গরু বেপারিরা কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন। হাটে পুতে রাখা বাঁশের খুঁটিতে হাজার খানেক গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে টানানো হয়েছে ত্রিপল। তবে বাজারে এখনও ক্রেতার দেখা নেই, নেই বিক্রেতারও হাঁকডাক।
হাটে উপস্থিত বেপারিরা জানান, এখনও পুরোদমে গরু আসা শুরু হয়নি। কাল বা পরশু (বুধ ও বৃহস্পতিবার) থেকে নগরের হাটগুলোতে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে পশু আসতে শুরু করবে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রাকে ট্রাকে গরু আসতে আরও দু'দিন সময় লাগবে।
পাঁচটি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন কুষ্টিয়ার আতিকুল। জিজ্ঞাসা করতেই জবাব, চট্টগ্রামে গরুর দামটা বেশি পাওয়া যায়, তাই এবার তাড়াতাড়ি গরু নিয়ে হাটে চলে এসেছি। পরে আসতে অনেক সমস্যা হয়। এছাড়া তাড়াতাড়ি আসায় অতিরিক্ত চাঁদাবাজি থেকেও বাঁচা গেছে।
অপর বেপারি মোনাফ জানান, এবারও পশুবোঝাই ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। নগরের প্রবেশ মুখ থেকে হাটে প্রবেশের আগ পর্যন্ত কয়েক দফায় চাঁদা দিতে হয়েছে।
সাগরিকা পশুর হাট সমিতির সহ-সভাপতি মো. হাসান জাগো নিউজকে বলেন, কিছু কিছু বেপারি কোরবানির পশু নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। তবে এখনও বিক্রি শুরু হয়নি। হাটগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
আরএস/এমএআর/জেআইএম