আফরোজাদের ঘরে হাঁটু পানি, তবুও মাফ নেই কিস্তি
বাড়ির ভেতর হাঁটু পানি, ঘরের মধ্যেও পানি; তবে বসবাস করতে হচ্ছে চৌকিতে। চৌকিতে রান্না, সেখানেই খাওয়া-ঘুমানো। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার শেষপ্রান্তে নদীর ধারে এই পাড়ার নাম বাউশি। এখানে বসবাস কয়েক হাজার মানুষের। বন্যায় ডুবে গিয়েছিল পুরো এলাকা, বর্তমানে পানি কমতে শুরু করলেও বাড়ির মধ্যে এক হাঁটু পানি রয়ে গেছে।
হাঁটু পানি ভেঙে বাউশি পাড়ার শেষ অংশের দিক থেকে এগিয়ে আসছেন এক গৃহবধূ। হাতে একটা হলুদ রঙের ছোট বই। হাঁটু পানি ভেঙে যখন তিনি তার বাড়ির ঠিক কাছাকাছি তখনই আলাপ হয় তার সঙ্গে। পাশেই ছিল তার সাত বছরের মেয়ে রিশি। সে ফুলছড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, কিন্তু অতিরিক্ত বন্যার কারণে ডুবেছে তার স্কুলও। ফলে বেশ কিছু দিন থেকে রিশিকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। যে কারণে সে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল কিস্তি পরিশোধ করতে।
ওই গৃহবধূর নাম আফরোজা আক্তার হাওয়া। এই বন্যা শুরু হওয়ার ঠিক আগে একটি বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি তুলেছেন। সেই টাকা দিয়ে স্বামীকে কিনে দিয়েছেন ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি। এখান থেকে যে আয় আসত সেই আয়ে চলত তাদের সংসার এবং কিস্তি। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তাদের সবকিছু তছনছ করে দিল। বন্যার কারণে ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন উঁচুস্থানে খোলা আকাশের নিচে। ছিল খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা। এখন যখন কিছুটা পানি কমে আসছে তখন ফিরে এসেছেন নিজ ঘরে কিন্তু ঘরের মধ্যে এখনও থেকে গেছে তাদের গ্রাস করা বন্যার পানি।
আফরোজা আক্তার হাওয়া জানালেন, ঘরে খাওয়ার কিছু নেই, নেই রান্না করার ব্যবস্থা। কোনোমতে একবার রান্না করে খাচ্ছেন তিন বেলা, কখনও না খেয়েও থাকতে হচ্ছে। রাস্তাঘাটে বন্যার পানি থাকায় স্বামী রাজা মিয়াও ঠিকমতো চালাতে পারছে না কিস্তির টাকায় কেনা ভ্যানগাড়ি। সংসারে শুরু হয়েছে ভয়াবহ অভাব-অনটন। এ অবস্থায় সেই গলার কাঁটা কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে তাকে। এক হাঁটু পানি ভেঙে পাড়ার মধ্যে আসা এনজিওকর্মীদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে টাকা।
এই টাকা কোথায় পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আফরোজা আক্তার বলেন, বাড়ির হাঁস-মুরগি, ছাগল বিক্রি করে টাকা দিয়ে আসতে হচ্ছে। সপ্তাহের প্রতি রোববার যেখান থেকে পারি টাকা এনে তাদের দিতে হচ্ছে। কোনো সপ্তাহে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে গালিগালাজ করে তারা। হুমকি দেয় বাড়ির টিন, চালা খুলে নিয়ে যাবে। তাই না খেয়ে থেকে হলেও সেই টাকা জমিয়ে কিস্তি দিতে হয়।
তিনি বলেন, ৩০ হাজার টাকা কিস্তিতে তুলেছি। প্রতি সপ্তাহে ৮০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। এভাবে চলবে ৪১ সপ্তাহ। কী আর করার এর মধ্যে ধারদেনা করে এই কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। নিজের বাড়িতেও ঠিকমতো রান্না হয় না। চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। আর রান্না করতে হলে চৌকি-খাটের ওপর চুলা জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করতে হয়। একবেলা রান্না করলে তিন বেলা খাই। খাওয়ার পানি আনতে যেতে দূরে উঁচু জায়গার টিউবওয়েলে। সবকিছুর মধ্যে রোববার আসলে ধারদেনা, সংসারের জিনিস বিক্রি করে কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
প্রসঙ্গত, উজান থেকে নেমে আসা পানি ও প্রবল বৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানিতে প্লাবিত হয় গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকা। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ব্যাপক জলমগ্ন অবস্থায় ছিল। বর্তমানে কিছুটা পানি কমে এলেও অনেকের ঘরবাড়িতে পানি রয়ে গেছে। পানিবন্দি এখনও অনেক মানুষ, যাদের রয়েছে খাদ্যসংকট। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত বানভাসি লোকজন এখনও ঘরে ফিরে যেতে পারছে না। গবাদি পশুর খাদ্যসংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং স্যানিটেশন সমস্যা প্রকট হয়েছে। ফলে পানিবন্দি মানুষদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানে।
প্রতিবারের মতো এবারও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম। এই উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করছে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গত শুক্রবার সকালে লালমনিহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তা ব্যারেজে ত্রাণসমগ্রী বিতরণের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে জাগো নিউজ টিম। নীলফামারী ও লালমনিরহাটে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের পর শনিবার চলে কুড়িগ্রাম জেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় আজ (রোববার) গাইবান্ধায় ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং আগামীকাল সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হবে। বন্যার্তদের জন্য এবার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগিতায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, ডাল, মুড়ি, পানি, বিস্কুট, স্যালাইনসহ নানা খাদ্যসামগ্রী।
জাগো নিউজের এবারের ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম দলে রয়েছেন জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জিয়াউল হক, জাগো নিউজের সহকারী বার্তা সম্পাদক মাহাবুর আলম সোহাগ, ওয়েব ইনচার্জ হাসিবুল হাসান আশিক, নিজস্ব প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফয়সাল খান ও নিজস্ব আলোকচিত্রী মাহবুব আলম।
এএস/বিএ/এমএস