প্রতি ১৪ মিনিটে একজন ভর্তি, কাতরাচ্ছেন সব বয়সীরা
মোস্তফা লাবু। পেশায় প্রাইভেটকার চালক। রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকার এক ব্যবসায়ীর গাড়ি চালান। গত সাতদিন ধরে শরীরে জ্বর অনুভব করছিলেন। তিন বেলা তিনটা নাপা এক্সট্রা খেয়ে জ্বর নিবারণের চেষ্টা করেন তিনি।
দুদিন আগে দুই হাতে রেশ, বমি-বমিভাব আর চোখে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করায় উদ্বিগ্ন হয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। চিকিৎসক দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভর্তির পরামর্শ দেন। টেস্টে ধরা পড়ে, তিনি ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত।
মঙ্গলবার ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের ষষ্ঠতলার মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ঘুমিয়ে আছেন। ক্লান্ত শরীরে পাশে স্ত্রী ও চার বছরের শিশুসন্তানটি বসে আছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় দিশেহারা পরিবারটি।
আরও পড়ুন >> ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় আতঙ্কে খোদ চিকিৎসকরাও
মোস্তফার মতো ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের চার, পাঁচ ও ছয় তলায় মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। সর্বশেষ সোমবার (২২ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট ৯৯ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসাবে প্রতি ১৪ মিনিটে ভর্তি হচ্ছেন একজন রোগী। এছাড়া আগের দিন রোববার নতুন ভর্তি ছিল ৮৯ জন। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৪৯ জন। ঢামেক হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চার রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
নতুন ভবনের মতো একই চিত্র ঢামেক হাসপাতালের পুরাতন ভবনের শিশু বিভাগে। সেখানেও অধিকাংশ শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। চিকিৎসকরা বলছেন, মূলত তিন থেকে আট বছরের শিশুরা বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। দেড়-দুই বছরের শিশুরাও আসছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। ঢামেকের মেডিসিন আর শিশু বিভাগগুলোর কেবিন, ওয়ার্ড, বারান্দা— সব স্থানেই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি।
আরও পড়ুন >> মশায় কুপোকাত ঢাকার দুই মেয়র!
ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন মোট এক হাজার ৬৪ জন। যাদের মধ্যে ৯১১ জন ভর্তি হয়েছেন গত ২২ দিনে। এছাড়া জানুয়ারিতে তিনজন, ফেব্রুয়ারিতে শূন্য, মার্চে চারজন, এপ্রিলে তিনজন, মে মাসে আটজন, জুনে ১৩৫ জন ভর্তি হয়েছেন। তবে জুলাইয়ের ২২ দিনে এক লাফে এ সংখ্যা ৯১১-তে উন্নীত হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এ বছরের জুলাইয়ের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্য যেকোনো বছরের যেকোনো মাসের তুলনায় ভয়াবহ।
এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আজ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মোট ৩৪৯ জন ঢামেকে চিকিৎসাধীন। প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী হাসপাতালের আউটডোরে আসছেন। যাদের অবস্থা খারাপ মনে করছি, আমরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করছি। জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা হাসপাতালের জন্য একটি বারডেন (বোঝা)। তবে আমরা আমাদের মতো পরিস্থিতি ম্যানেজ করছি।
তিনি আরও বলেন, একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, আগে অনেকে ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর হাসপাতালে আসতেন। এখন জ্বর হলেই ডেঙ্গু সন্দেহে হাসপাতালে আসছেন তারা। এতে দ্রুত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন >> ডেঙ্গুর কাছে হেরে গেল শিশু লাবণ্য
ওয়ারীর লিটেল মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিনাজ নূর গত আটদিন ধরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি। সে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে আক্রান্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু ধরা না পড়ায় তার অবস্থা এখন আশঙ্কাজনক।
মাহিনাজের মা শাহনাজ নূর জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকদিন জ্বরের পর তার পায়খানার সঙ্গে যখন রক্ত যেতে থাকে, তখন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখান থেকে তারা ঢামেকে নেয়ার পরামর্শ দেয়। জ্বরে ওর শরীর এখনও দুর্বল। খাওয়ায় রুচি নেই, কিছুই খেতে পারছে না।
শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে ঢামেক শিশু বিভাগের (বহির্বিভাগ) আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে তিন থেকে আট বছর বয়সীর সংখ্যাই বেশি। শিশুদের ডেঙ্গু যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না যায়, তাহলে এ জ্বরের কারণে শরীরে পানি কমে যেতে পারে। কিডনিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় তারা। ফলে তাদের বাঁচানো কষ্টকর হয়ে পড়ে।
আজ সকাল থেকে আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ২০ শিশুকে দেখেছি। তাদের মধ্যে দুজনের ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ছিল। বাকিরা প্রাথমিক পর্যায়েই এসেছে।
এআর/এমএসএইচ/আরএস/এমএআর/এমএস