সাধারণ মানুষের ভরসা হয়ে উঠছে ‘হ্যালো ওসি’
‘আমি ১৩ বছর ধরে মার্কিন পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। তবে গত দুই বছর ধরে সিএমপির সঙ্গে কাজ করছি। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, আপনাদের থানার ওসি মহসিন ভাইয়ের চালু করা কনসেপ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, ইপিট্যাপের মাধ্যমে বিশ্বের ১৩টি দেশের পুলিশ গ্রহণ করেছে। তারাও এই ‘হ্যালো ওসি’ কনসেপ্টটি কার্যকর করছে।’
কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, ইপিট্যাপের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট তানিক মুনীরের।
যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৪টি দেশে যে চিন্তাটি জায়গা করে নিল, কীভাবে হলো সেই চিন্তার শুরু? সময়টা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শুরুর দিকে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উপলক্ষে নগরের প্রতিটি থানায় ছয়টি আলাদা বুথে জনগণের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছিল। নগরের কোতোয়ালি থানায়ও তেমনই বুথ করা হয়েছিল। বাকি বুথগুলোতে পরিদর্শক ও উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা সেবা দিচ্ছিলেন। এর একটি বুথ পরিচালনা করছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন নিজেই।
সেবা সপ্তাহের এ আয়োজন চালাতে গিয়ে ওসি বুঝতে পারেন, জনসাধারণ বুথে এসে এভাবে সরাসরি কথা বলতে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। যারা থানায় এসে ওসির সঙ্গে বলতে চান না বা এড়িয়ে যান, তারাও তার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলছেন। তখনই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন একটি আলাদা বুথ প্রতিষ্ঠা করার। যে চিন্তা সেই কাজ! সব থানায় ৬টি হলেও কোতোয়ালি থানায় প্রতিষ্ঠা হয় একটি অতিরিক্ত বুথ। ওসি মোহাম্মদ মহসিন সেই বুথের নামকরণ করেন ‘হ্যালো ওসি’।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার থানায় পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে তৈরি বুথগুলোর একটিতে আমিও ছিলাম। বাকিগুলোতে কর্মকর্তা পর্যায়ের পুলিশ সদস্য ছিলেন। তখন কিছু মানুষ আমার কাছেও এলো, তাদের সমস্যার কথা জানাল। ঠিক তখন উপলব্ধি করলাম, অন্য সময় এই মানুষগুলোই আমাকে অকারণে এড়িয়ে চলে। ভুল কিছু ধারণা পোষণ করে, পুলিশের কাছে আসতে চায় না। থানার কাজে পুলিশের বদলে দালালদের কাছে ধরনা দেয়। তাদের ধারণা পুলিশের কাছে আসা মানেই সমস্যা।’
“এই চিন্তা থেকে ওইদিনই আমার থানায় আরও একটি অতিরিক্ত বুথ প্রতিষ্ঠা করলাম। নাম দিলাম ‘হ্যালো ওসি’। সেখানে বসেই থানায় আসা মানুষের সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করলাম” বলেন ওসি মোহাম্মদ মহসিন।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ স্বপ্নজয়ী সে মানুষটার কথাগুলো একেবারেই মিলে গেল ওসি মোহাম্মদ মহসিনের ক্ষেত্রে। ‘হ্যালো ওসি’ নিয়ে তিনি শুধু থানায়ই বসে থাকতে চাইলেন না। যেতে চাইলেন মানুষের আরও কাছাকাছি...
ওই ঘটনার পাঁচ মাস পরের এক বিকেল। চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার জামতলা এলাকা। ব্যতিক্রমী এক থানায় ছুটে আসতে থাকেন সেবাপ্রার্থীরা। তারা প্রাণ খুলে কথা বলেছেন থানার বড় কর্তার সঙ্গে। শুধু ভুক্তভোগীই নন, অনেক অপরাধীও আসছেন অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে আসার আকুতি নিয়ে। কেউ জানাচ্ছেন ব্যক্তিগত অভিযোগ, কেউ বলছেন এলাকার নানা সমস্যার কথা। অপরাধমুক্ত এলাকা গড়তে দিচ্ছেন সুন্দর কিছু প্রস্তাবও। ওসি নিজেই টুকে নিচ্ছেন অভিযোগ, সমাধানযোগ্য বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকই সমাধান করছেন। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে আইনি সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন। নিজ এলাকায় বসেই ওসিকে অভিযোগ দিতে পেরে খুশি মানুষ। দিনটি ছিল ১০ জুলাই।
এভাবেই নিজ উদ্যোগে ‘হ্যালো ওসি’ নামের এমন একটি ব্যতিক্রমী সেবা নিয়ে জনগণের আরও কাছাকাছি হলেন কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন। প্রাথমিকভাবে বেশ সাড়া পাওয়ায় এখন মহানগরের সব থানায় এ কার্যক্রম চালুর নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান। গত বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুরে সিএমপির মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় মাহবুবর রহমান নগরীর ১৬ থানার ওসিকে এ কার্যক্রম চালু করার নির্দেশ দেন। এ ধরনের কার্যক্রম চালু থাকলে থানায় থানায় হয়রানি বা সেবা না পাওয়ার অভিযোগও অনেকটা কমে আসবে বলে মত পুলিশ কর্মকর্তাদের।
ওসি মোহাম্মদ মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিষয়টা নিয়ে ঢাকঢোল পেটাতে চাইনি। চেয়েছিলাম আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মানুষের সমস্যা শুনে সমাধান করতে। আমাদের সমাজে থানা নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। মানুষ থানায় আসতে চায় না। থানায় যারা বিভিন্ন অভিযোগ কিংবা প্রতিকার চাইতে আসেন, তারা ওসির কক্ষে যাওয়াটাকে অনেক কঠিন বিষয় মনে করেন। যেন ওসি মানুষের চাইতে ভিন্ন কিছু। এই মনোভাব পাল্টে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলতে থানাকেই মানুষের কাছাকাছি নেয়ার চিন্তা করলাম। সে চিন্তার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখলাম, এ পদ্ধতিটা খুব কার্যকর। মানুষের ব্যাপক সাড়া পেলাম। মানুষ নির্ভয়ে আমাদের কাছে তাদের সমস্যা বলেছিলেন।’
রোববার (২১ জুলাই) ‘হ্যালো ওসি’র কার্যক্রম দেখে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্টের জাস্টিস বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক স্টিভ লেটিক, যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন পুলিশের ব্রায়ান মুনোজ ও জয় পেনথেনি।
তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশিং ব্যবস্থা আর যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশিং ব্যবস্থা ভিন্ন। তাই আমরা দুই দেশের পুলিশ পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ভিত্তিতে সেবাপ্রদানের পদ্ধতিগুলো শেয়ার করি। তবে জনবহুল এলাকায় কীভাবে জনগণের মাঝে পুলিশি সেবা দেয়া হয়, এখানে এসে সেটা নতুন করে দেখলাম। এসব ব্যতিক্রমী কার্যক্রম দেখে আমরা মুগ্ধ। এ ধরনের ব্যতিক্রমী পুলিশি কার্যক্রম আমরা চাই বাংলাদেশের সব থানায় ছড়িয়ে যাক।’
সর্বশেষ নগর পুলিশের মাসিক অপরাধ সভায় বিষয়টি আলোচনায় আনেন সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান। এ সময় ওসি মহসিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে নগরীর অন্যান্য থানার ওসিকেও তার মতো করে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা দেন তিনি।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, নগরীর ১৬ থানার ‘হ্যালো ওসি’ বুথ স্থাপন করে স্ব-স্ব থানার ওসি এর কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। রিমোট এলাকায় কিংবা যেসব এলাকার লোকজন থানায় আসতে পারে না, সেসব এলাকায় গিয়ে ওসিরা জনগণের সঙ্গে কথা বলবেন। তাদের কথা শুনে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করবেন। প্রতি থানায় মাসে অন্তত দুবার এ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সিএমপি কমিশনার নির্দেশ দিয়েছেন।
আবু আজাদ/বিএ/এমকেএইচ