গরলে সরল মিশিয়ে চিরনিদ্রায় এরশাদ
মৃত্যু মানুষকে মহান করে। দেহের সঙ্গে চাপা পড়ে যায় তার দোষও। মৃত ব্যক্তির ভালো দিকগুলো সামনে এনে চলে তার গুণকীর্তন। কিন্তু ইতিহাস কী আসলে সব ক্ষমা করে!
না। শাসকের সমস্ত বিধান মেনে নিলে মানুষের মাঝে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র থাকত না। শাসকেরা বেঁচে থাকেন ভালো এবং মন্দ উভয় কর্মের মধ্য দিয়েই।
সাবেক রাষ্ট্রনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মধ্যেই। এরশাদের মৃত্যুতে শোক চলছে। শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীও। বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে এরশাদের প্রিয় আবাসস্থল রংপুরের মাটিতেই দাফন হলো।
গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমেও এরশাদের জন্য শোক জানিয়ে লিখছেন অনেকে। অনেকে সফল রাষ্ট্রনায়ক, উন্নয়নের রূপকার হিসেবে হাজির করছেন তাকে।
গণতন্ত্রের আড়ালে উন্নয়নকে বড় করে এরশাদের দৃশ্যমান সফলতাকে এগিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের সাক্ষ্য হিসেবে প্রমাণ দিচ্ছেন কেউ কেউ।
এর মধ্যে পল্লী উন্নয়নে এরশাদের প্রশংসা মিলছে ব্যাপকভাবেই। জনপ্রিয় হলেও অবকাঠামো উন্নয়নে এরশাদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হলফ করে বলা যেতেই পারে। বিশেষ করে রাস্তাঘাট, কালভার্ট নির্মাণে এরশাদের আমলে যে বিশেষ পরিবর্তন এসেছিল, তা স্মরণীয়।
এরশাদ জামানার সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল গ্রামের উন্নয়ন। গ্রামের উন্নয়ন আলোচনায় এনে এরশাদ পল্লীবন্ধু উপাধিও পেয়েছিলেন। উপজেলা নির্বাচনের প্রবর্তন করে তিনি মূলত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিলেন। বিচার ব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করেছিলেন এরশাদ।
এরশাদের আমলেই গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্টসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে। এ সময় স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনও নির্মাণ হতে দেখা যায়। তিস্তা সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে উত্তরবঙ্গের কৃষি উন্নয়নে আকাশসম স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সামরিক এই প্রশাসকই গ্রামে-গঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের প্রবর্তন করেন।
গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতায়নের সংযোগ ঘটে তার আমলেই। প্রশাসনের বিকেন্দীকরণের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে এরশাদ ২১টি জেলাকে ভেঙে ৬৪টি জেলায় করেছিলেন। জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করে গণপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দেন, যার কেন্দ্রে ছিল পল্লীর উন্নয়ন।
পল্লীবন্ধু খ্যাত এরশাদ গ্রামের উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদকে অধিক শক্তিশালী রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। তার সময়েই ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়।
তবে এসবের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রেই ছিল ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার সরলীকরণ। প্রতিজন শাসকই এমন সরল পথে হাঁটতে চান। দৃশ্যমান জনপ্রিয় কর্মকাণ্ড সামনে এনে কর্তৃত্ব আরও বাড়িয়ে তোলেন। একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্যু’র মাধ্যমে হটিয়ে এরশাদও সে পথেই হেঁটেছেন।
সংবিধান সংশোধন করে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেছিলেন। এই ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ ইসলামের যে কোনো উপকারে আসতে পারে না, তা যে কোনো মুসলমানই স্বীকার করবেন। বরং সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে ধর্মীয় রাজনীতিকে উসকে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি অবস্মরণীয় ঘটনা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় এরশাদ পুরোদস্তুর পাকিস্তান সেনাবাহিনী চাকরি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই তিনি পাকিস্তানে চলে যান। ফিরে আসেন দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ পরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এরশাদের কী ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল বরাবরই। অথচ দেশে ফেরার বঙ্গবন্ধু এই সৈনিককে পদোন্নতি দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় ভারতে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। অথচ এমন একটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এরশাদের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। বরং ভারতে থাকা অবস্থাতেই তিনি পদোন্নতি পান। ক্ষমতায় থাকাকালে কর্নেল ফারুকের মতো বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করেছিলেন।
বলা হয়, জিয়াউর রহমানের সময়ই সৈনিক এরশাদ সবচেয়ে বেশি সুবিধা গ্রহণ করেন। উপর্যুপরি পদোন্নতি দিয়ে জেনারেল জিয়া আরেক জেনারেল এরশাদকে সেনাপ্রধান করেন। অথচ জিয়া হত্যার নেপথ্যের নায়ক এরশাদকেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। যদিও জিয়া হত্যার তদন্ত নিয়ে রহস্যের অন্ত মেলেনি। তবে মঞ্জুর হত্যার অভিযোগ নিয়েই কবরে গেলেন এরশাদ।
উপরে ভালো মানুষি সেজে রক্তের সিঁড়িও কম মাড়াননি এই সেনাশাসক। এরশাদের জামানার রাজনৈতিক ইতিহাস টানলে নূর হোসেন, সেলিম-দেলওয়ার, বসুনিয়া-জয়নাল-জাফর-দীপালি সাহা, ডা. মিলনদের রক্ত আরও রঞ্জিত হয়। রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা এরশাদের ক্ষমতাকালে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে পুলিশ গুলি চালায়।
চট্টগ্রামের ওই হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের রূপ দিয়ে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান কবিতা পরিষদের প্রতিবাদী মঞ্চে বসে এঁকেছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’। আর এটিই ছিল এরশাদের চরিত্রের সঙ্গে যুৎসই চিত্রশিল্প।
এরশাদ রাজনীতি করেছেন, অথচ রাজনীতির ক্রান্তিকালে থেকেছেন নির্বিকার। রাষ্ট্র, সমাজের অনিয়ম, অসঙ্গতি নিয়ে এরশাদ শুধু রাজনীতিই করেছেন। আজ দুর্নীতির যে ভয়াবহতা সমাজে, তার গোড়া পত্তন এরশাদ আমলেই। দুর্নীতির দায়ে জেলও খেটেছেন এই সেনাশাসক।
রাজনীতির মাঠে এরশাদ অস্থির থেকেছেন তুরুপের তাস সেজে। যেখানে সুবিধা সেখানে নোঙর ফেলেছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের কাছ থেকেই সুবিধা নিয়েছে, সুবিধা দিয়েছেন, যেখানে নীতির পরাজয় ঘটেছে বারবার।
সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মতোই এরশাদের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত। অথচ এই রাজনীতিকের সঙ্গেই বারবার জুটি বেঁধেছেন মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো।
এক সময়ের দাপুটে স্বৈরশাসক এরশাদ তার জীবনকে বৈচিত্রময় করছেন রাজনীতির বাইরে হেঁটেও। নারী, প্রেম, কবিতা, গানে থাকা তেমনই সরলীকরণের সমীকরণ। অথচ গরল কখনও সরল হয় না।
এএসএস/এমআরএম