পানি যাবে কোথায়?
>> ৩৮ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম হারিয়েছে ১৮ হাজার জলাধার
>> ফ্লাইওভারে জলাবদ্ধতার ছবি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল
>< চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
‘জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য এক ধরনের বিপ্লব প্রয়োজন। ঢাকার খালগুলোর মধ্যে এখন দুইটাও বোধহয় নেই। খাল ভরাট করে সেখানে চার-পাঁচতলা ভবন করা হয়েছে। পানি যাবে কোথায়?’-কথাগুলো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের।
ঢাকা মহানগর নিয়ে কথাগুলো বলা হলেও প্রয়াত মেয়রের যৌবনের শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যেন একটিু বেশিই প্রাসঙ্গিক।
শুধু কি খাল? একদিকে ভূমি দস্যুদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি পুকুর, দিঘি এমনকি ডোবা-নালাও। অন্যদিকে, নগরীর বড় বড় প্রাকৃতিক জলাধারগুলো দখল করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নিজেই গড়ে তুলেছে আবাসিক এলাকা। আবার কোথাও জলাধারের জায়গায় দখল করে ভবন নির্মাণ কিংবা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার অনুমোদন দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থায় নিজের জায়গা হারিয়ে রাস্তায় উঠে যাওয়া কিংবা বাড়িতে প্রবেশের দায় কি শুধুই পানির?
নগরে প্রধান সড়কের ওপরেই লালখান বাজার থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে আখতারুজ্জামন ফ্লাইওভার। তাই মাঝখানে এই বিশাল আইল্যান্ড। আইল্যান্ডের কারণে রাস্তায় পানি আটকে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধাতার
সাম্প্রতিক সময়ে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যাচ্ছে নগরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা অক্সিজেন মোড়ে। কোমর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ (কুয়াইশ সংযোগ সড়ক), ওয়াইজদিয়া, মাজার গেট, বালুচরা, কুয়াইশসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। অথচ দশ বছর আগেও এসব এলাকায় বর্ষায় পানি উঠতে দেখেনি কেউ।
উত্তর হাটহাজারী ও নগরের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে ওঠা অনন্যা আবাসিকের পুরো জায়গা জুড়ে ছিল এক ঝিল। যা বর্ষায় নগরের দক্ষিণ অংশের (চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ) এলাকার প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই সেই ঝিল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক এলাকা। যার কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যাচ্ছে অক্সিজেন মোড়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায়।
শুধু অনন্যা আবাসিক এলাকা নয়। নগরীর পশ্চিমের আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক, দক্ষিণের কল্পলোক আবাসিক এলাকা, রামপুর ওয়ার্ডের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা সবই গড়ে উঠেছে নগরের নিম্নাঞ্চল ও বিল-ঝিল দখল করে, প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধ্বংস করে। এ ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে নগর বাঁচানো দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নিজেই।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৩৮ বছরে চট্টগ্রাম নগরীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৮ হাজার জলাধার। ১৯৯১ সালের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, ওই সময় চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। ২০০৬-০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আরেক জরিপে দেখা যায়, নগরীতে জলাশয়ের পরিমাণ মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। তবে বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে তার কোনো সঠিক চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগের কাছে নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে তার এক জরিপে দেখান, চট্টগ্রামে তখন জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪১। ১০ বছর পর ১৯৯১ সালে আরেকটি জরিপ শেষে তিনি জানান, এর আগের ১০ বছরে প্রায় ১৩ হাজার জলাশয় হারিয়ে গেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে চট্টগ্রামে এক হাজারেরও কম জলাশয় বিদ্যমান রয়েছে।
একসময় চট্টগ্রাম নগরের বৃষ্টির পানি ধারণের অন্যতম জলাধারগুলো ছিল-ঐতিহ্যবাহী ‘দেওয়ানজী পুকুর', ‘রাজা পুকুর', ‘রথের পুকুর', ‘মৌলভী পুকুর', ‘মিনা মার দিঘি', ‘মোহাম্মদ খান দিঘি', ‘কমলদহ দিঘি', ‘কর্নেল দিঘি', ‘কর্নেলহাট দিঘি', ‘হাজারীর দিঘি', ‘দাম্মা পুকুর', ‘কারবালা পুকুর', ‘লালদিঘি', ‘বলুয়ার দিঘি', ‘রানির দিঘি', ‘আগ্রাবাদের ঢেবা', ‘মুন্সি পুকুর', ‘ভেলুয়ার সুন্দরীর দিঘি', ‘কাজীর দিঘি'। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় প্রশাসনের চরম দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার কারণে সেসব আজ ইতিহাস।
নগরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে দালান ও ঘরবাড়ি-১
এর মধ্যে ভরাট হয়ে গেছে আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ান বাজারের দেওয়ানজি পুকুর, নন্দনকানন রথের পুকুর, চান্দগাঁও মৌলভী পুকুর, ফিরিঙ্গি বাজার ধাম্ম পুকুর, বহদ্দারহাট এলাকার মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলী সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি।
অ্যাডভোকেট এ এম জিয়া হাবীব আহ্সান বলেন, ‘লালদিঘি, বলুয়ার দিঘি, রানির দিঘি, আগ্রাবাদের ঢেবা, মুন্সি পুকুর, ভেলুয়ার সুন্দরীর দিঘি, কাজীর দিঘি ছিল দর্শনীয় বস্তু। একসময় ভেলুয়া সুন্দরীর দিঘি দেখতে দূরদুরান্ত থেকে লোকজন আসত। নগরীর প্রাণকেন্দ্রের আসকারদিঘিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজায় প্রতীমা বিসর্জনের দৃশ্য দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় হতো। কিন্তু গত ২০ বছরে ভূমি দস্যুদের থাবা আর সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে এসব দীঘির অনেকগুলোই দখল হয়ে গেছে। বাকিগুলো তার রূপ, যৌবন সব কিছুই হারিয়েছে, হারিয়েছে পানির ধারণক্ষমতাও।'
নগরের চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ থানার আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা, ওয়াইজদিয়া, ফরিদের পাড়া, শমসের পাড়া, অদূর পাড়া, হাজিপাড়া ও ইসলামী ডেন্টাল কলেজের মাঝখানের বিশাল বিলটিতে শুকনো মৌসুমে ধান ও ফসল ফলায় কৃষকেরা। তবে বর্ষায় এ বিশাল বিল নগরের প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নগরের অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাধারগুলোর ভাগ্য অতটা প্রসন্ন নয়। তাইতো নগরের বিখ্যাত বগারবিলে কল্পলোক আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার পর থেকে বাকলিয়ার বিশাল এলাকার মানুষ পানিবন্দি থাকছে। রামপুর ওয়ার্ডে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা হওয়ার কারণে দেওয়ানহাট, ঈদগাহ, মনসুরাবাদ, শানিত্মবাগ, হালিশহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি থাকছে। অনন্যা আবাসিকের কারণে অক্সিজেন মোড় এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কথাতো আগেই বলা হয়েছে।
নালায় আটকে আছে নগরের কঠিন বর্জ্যের একটা অংশ। আর তাতেই রাস্তায় উঠে গেছে পানি
বন্দরনগরীর সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতাকে আড়াল করতে কেউ অতি প্রাকৃতিক অবস্থাকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, বৃষ্টি বেশি হচ্ছে, তাই চট্টগ্রামও ডুবছে। এক্ষেত্রে তারা ওয়াশিংটন ডিসি ও হোয়াইট হাউসে পানি প্রবেশের প্রসঙ্গকে সামনে আনছেন। প্রশ্ন হলো- চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও কি সে যুক্তি খাটে?
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জাগোা নিউজকে বলেন, ‘একদমই না! মৌসুমি বায়ু সক্রিয়তার কারণে টানা বর্ষণ হচ্ছে। এটা বর্ষাকাল, বর্ষাকালে বৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাত কমছে। গতকালও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম ছিল। তবে রোববার (১৪ জুলাই) থেকে বৃষ্টির পরিমাণ আরও কমে আসতে পারে।’
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস বলছে, গত পাঁচদিনে চট্টগ্রাম নগরীতে মোট ৬১৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। গত সোমবার (৮ জুলাই) নগরীতে সর্বোচ্চ ২৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া রোববার ৬৬ মিলিমিটার, মঙ্গলবার ৬৯ মিলিমিটার, বুধবার ১৪৬ মিলিমিটার ও বৃহস্পতিবার ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসাইনের মতে, প্রধানত তিনটি কারণে চট্টগ্রামের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সমস্যা হচ্ছে।
নগরের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে গড়ে উঠেছে অনন্যা আবাসিক এলাকা
প্রথমত, পুরো চট্টগ্রাম নগরীটাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেছে, এখনো সে প্রক্রিয়া চলমান আছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে শহরের বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন। আর এ কারণে ফ্লাইওভারে জলাবদ্ধতার ছবি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল।
দ্বিতীয়ত, নগরের কঠিন বর্জ্যের একটা অংশ সরাসরি ড্রেনে ফেলা হচ্ছে। যা পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাটে পানি জমে যায়।
তৃতীয়ত, চট্টগ্রাম নগরীর ৫৭টি খাল একসময়ে পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু এখন এই খালগুলো খুঁজে পাওয়াও কঠিন। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকার প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট করে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় বড় এই শহরের পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
নগরের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে গড়ে উঠেছে অনন্যা আবাসিক এলাকা
সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা খাল উদ্ধারে কথা বলছি, নালা তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছি, কিন্তু ভাবছি না এই খাল-নালা দিয়ে পানিগুলো কোথায় যাবে? শুধু খাল আর নালাগুলোর পক্ষে এত বিশাল শহরের পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘একসময় টানা বর্ষায় শহরের পানি দিঘি, পুকুর আর বিল-ঝিলে জমা হতো। তাই রাস্তায় পানি জমার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু মানুষ যেভাবে পুকুর, দিঘি আর ঝিল-বিলগুলো ভরাট করে বাড়ি করছে, তাতে নগরের পানির প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট হয়ে বৃষ্টির পানির ধারণক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। আর এ কারণে খালের পানি উঠে আসছে রাস্তায়, নালার পানি প্রবেশ করেছে ড্রইংরুমে।’
এসআর/পিআর