রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত : চালকরা বলছেন, ‘পেটে লাথি মারবেন না’
রাজধানীর উত্তর বাড্ডা সড়কের পাশে রিকশা রেখে ফুটপাতে বসে গল্প করছিলেন দুই রিকশাচালক। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে আরও কয়েকজন রিকশাচালক তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাদের আলোচনার বিষয় সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয় নিয়ে।
এসব রিকশাচালকের একজন সিদ্দিকুর রহমান। বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। তিনি ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আজ সকালেই জেনেছি যে, আগামী ৭ জুলাই থেকে বিভিন্ন সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়া মানে অসহায়-দরিদ্র রিকশাচালকদের পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরে অধিকাংশ রিকশাচালক গ্যারেজ থেকে ১০০-১২০ টাকা জমা খরচ দিয়ে রিকশা নেন। সারাদিন চালিয়ে দিন শেষে ৪০০-৫০০ টাকা তারা আয় করেন। এ আয় দিয়েই সংসার চলে। কিন্তু সড়কে যদি রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এসব রিকশাচালক কী করবে? কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাদের বিষয়ে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
এ সময় পাশে থাকা আরেক রিকশাচালক এরশাদ আলী বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেক রিকশার গ্যারেজ আছে। প্রতিটি গ্যারেজ মালিকদের ৫০-১৫০টি করে রিকশা আছে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসহায়, দুস্থ, কর্মসংস্থানহীন মানুষ রাজধানীতে এসে গ্যারেজ মালিকদের থেকে ভাড়ায় রিকশা নিয়ে চালায় জীবিকার তাগিদে। এখন সড়কে যদি রিকশা চলতে না দেয়া হয় তাহলে এসব রিকশাচালক গিয়ে ভিড় করবে গলির ভেতরে। এত রিকশা কি গলির ভেতরে চলতে পারে? তাহলে এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অবশ্যই আমাদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গলির মধ্যে রিকশা চালালে আমাদের আয় অর্ধেকে নেমে আসবে। তাহলে আমরা খাব কী আর বাড়িতে টাকা পাঠাব কীভাবে?’
বুধবার (৩ জুলাই) ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে ডিটিসিএর (ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথরিটি) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ হচ্ছে। আগামী রোববার (৭ জুলাই) থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। প্রাথমিকভাবে গাবতলী থেকে আসাদগেট হয়ে আজিমপুর পর্যন্ত এবং সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রিকশা চলাচল করবে না। এ ছাড়া কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা হয়ে খিলগাঁও-সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠক শেষে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘ঢাকা শহরের সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ডিটিসিএর বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার পর নাগরিকদের যেন চলাচলে সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিবহন মালিক সমিতি এবং বিআরটিসির পর্যাপ্ত বাসসেবার ব্যবস্থা করা হবে। আগামী ৭ জুলাই পরীক্ষামূলক ওই সড়কগুলোতে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে ১৪ জুলাই আবারো বৈঠকে বসবে সমন্বয় কমিটি।’
যানজট নিরসনের জন্য মূল সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হচ্ছে- এ বিষয়টির বিরোধিতা করে রামপুরা এলাকার রিকশাচালক রমজান আলী বলেন, ‘রিকশা চালকরা রাস্তার একপাশ দিয়ে রিকশা চালিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা হয়ে যেসব লোকাল বাস চলাচল করে তারাই মূলত সব জায়গায় যাত্রী উঠানো-নামানো করে। এতেই যানজট হয়। তুরাগ, ভেক্টরসহ একাধিক বাস যখন খানিক পরপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় তখনই যানজট সৃষ্টি হয়। সেখানে যানজটের জন্য এককভাবে রিকশাকে দায়ী করা অমানবিক।’
‘রিকশা বন্ধ করলে লাখ লাখ রিকশাচালক কী করবে? রিকশাচালকদের পেটে লাথি মারলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ‘
সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর রিকশাচালকদের জীবন-সংগ্রাম, দেশের পণ্য ও নাগরিক পরিবহনে তাদের প্রয়োজনীয়তা, অবদান এবং সংগঠিতকরণ বিষয়ে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।
সেখানে বলা হয়, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ রিকশায় চড়ে। রাজধানীতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) একমাত্র রিকশা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, যা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ৭৯ হাজার ৫৫৪ রিকশা লাইসেন্স ইস্যু করেছে। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের রিকশা প্রকৃত সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক। আনুমানিক ১৫ লাখ রিকশাচালক ও তাদের পরিবার ঢাকা শহরে রিকশার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকা শহরের সব রিকশাচালক অদক্ষ এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে স্থানান্তরিত। তাদের বেশিরভাগই পরিবার ছাড়াই ঢাকায় বাস করে এবং গ্রামের বসতবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে। ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা সীমিত করলে তাদের জীবিকার ঝুঁকি বাড়বে এবং এসব দুর্বল মানুষকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিকশাচালকদের মাসিক গড় আয় ১৩ হাজার ৩৮২ টাকা, যার ৬৮ শতাংশ আসে রিকশা চালনা থেকে। প্রায় ৯০ ভাগের একমাত্র পেশা রিকশা চালনা, যা এই পেশার ওপর তাদের একমাত্র নির্ভরতার ইঙ্গিত দেয়। রিকশাচালকরা অত্যন্ত দরিদ্র। প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কোনো জমি নেই।
ঢাকায় রিকশা চালনা শুরু করার আগে বেশিরভাগই (৫৭.১%) ছিল দিনমজুর, ১৩.৮% যুক্ত ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়, ১২.১% কৃষিকাজে। রিকশাচালক হিসেবে কাজে আসার পেছনে প্রধান কারণ ছিল অন্য কোনো কর্মসংস্থানের অভাব এবং এই পেশায় আসতে উৎসাহের কারণ ছিল এতে কোনো পুঁজি ও দক্ষতার প্রয়োজন নেই।
ঢাকায় থাকা অবস্থায় ৬২% রিকশা চালায় সপ্তাহে সাতদিন এবং ২৮% চালায় ছয়দিন। এরা দৈনিক ন্যূনতম এক শিফটের জন্য রিকশা চালায়, গড়ে নয় ঘণ্টা প্রতিদিন। ঢাকা শহরের প্রায় সকল রিকশা (৯৬%) চালকের মালিকানাধীন নয়। তারা প্রতিদিন গড়ে ১১১ টাকা পরিশোধ করে ভাড়ায় রিকশা চালায়। ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের সর্বনিম্ন উপার্জন দৈনিক প্রায় ৩৬৪.৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ উপার্জন দৈনিক প্রায় ৬৬৯.৮ টাকা। নিট গড় আয় দৈনিক প্রায় ৩৭১.৭ টাকা।
রাজধানীর মালিবাগ সংলগ্ন আবুল হোটেলের সামনে থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী জুয়েল আহমেদ। তিনি জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ রুটে সব লোকাল বাসেই অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ থাকে। এসব বাসে ওঠা মানেই ভোগান্তি। তাই এমন স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য রিকশা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের।’
তিনি বলেন, ‘এই রুটগুলোতে রিকশা বন্ধের আগে পর্যাপ্ত বাস বা গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে আমাদের মতো যাত্রীদের চরম ভোগান্তি হবে। পাশাপাশি লাখ লাখ রিকশাচালক যেন কর্মহীন হয়ে না পড়ে, সেই বিষয়েও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘যানজট নিরসনে প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু স্বল্প দূরত্বে রিকশায় চলাচল করে যাত্রীদের বড় একটি অংশ, তাই পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারলেই এই উদ্যোগ স্বার্থক হবে। তা নাহলে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়বেন স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারী যাত্রীরা।’
বন্ধের পাশাপাশি রিকশাচালকদের জন্যও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে জানান যাত্রী কল্যাণ মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘এটা করতে না পারলে তা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে। বসুন্ধরা, বারিধারা, বনানী, গুলশানের মতো এলাকাভিত্তিক রেজিস্ট্রেশন দিয়ে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। গলি, উপ-গলিতে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভাড়ায় রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা কর হবে। তাদের বিষয়ে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং মূল সড়কে রিকশা না থাকার ফলে যেন যাত্রীদের কোনো ধরনের ভোগান্তি না হয় সেই সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এসব পদক্ষেপ না নিয়ে রিকশা চলাচল বন্ধ করলে তা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।’
এএস/এসআর/পিআর