শিক্ষকদের আন্দোলনের জন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী
বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আক্রোশের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তার (অর্থমন্ত্রীর) এরকম ন্যাক্কারজনক মনোভাবের কারণে শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন। এর জন্য মূল দায় অর্থমন্ত্রীর।
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, এর আগেও আমরা আমাদের মান-মর্যাদার ব্যাপারে কখনো আপোস করিনি। বিভিন্ন আমলা এবং সামরিক বেসামরিক আমলারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ করেছে, আমরা তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছি, তাদেরকে প্রতিহত করেছি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে এই শিক্ষক নেতা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রী এর আগেও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আমরা মনে করি এটার একটা সুরাহা হওয়া উচিত। দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তার এরকম অবস্থান শিক্ষকরা কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে নিয়ে ঢালাওভাবে খারাপ মন্তব্য করা এবং শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও দাবি আদায়ের কৌশল নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপ করেছেন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
বুধবার তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মানিক মোহাম্মদ ও জাগো নিউজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুনির হোসাইন। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো :
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যে চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থমন্ত্রী, ঊনি বয়োজ্যেষ্ঠ লোক। একদিক দিয়ে আমি উনাকে সম্মানও করি। কিন্তু তিনি শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একটা ন্যাক্কারজনক মনোভাব পোষণ করে আসছেন। অজ্ঞাত কারণে তিনি হয়তো সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। জানিনা কোনো শিক্ষকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত মতবিরোধের কারণে তিনি এমনটা করছেন কি-না।
তিনি বলেন, এর আগেও বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার আক্রোশের শিকার হয়েছেন। আজকের আন্দোলন এ পর্যন্ত গড়ানোর জন্য তিনিই দায়ী। কারণ তিনি প্রতিবারেই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন।
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পে-কমিশনের রিপোর্টটা মূল চালিকাশক্তি ও দেখবাল করার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থেকে তার নেতিবাচক চিন্তা চেতনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ব্যাপারটি আক্রোশের মুখে পড়েছে।
এর আগেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে আসছেন দাবি করে এই শিক্ষক নেতা বলেন, আমরা মনে করি এটার একটা সুরাহা হওয়া উচিত। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনেভাবেই মেনে নেবে না। তিনি যে ধরনের কথা-বার্তা এবং ভাষা ব্যাবহার করেছেন ওইসবের আমরা নিন্দা করি।
শিক্ষকরা তাদের মান-মর্যাদার ব্যাপারে কখনো আপোস করবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় এক ধরনের আমলা এবং অসৎ রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে তখনও আমরা প্রতিহত করেছিলাম। বারবার করছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান দিয়েছেন এবং সম্মানের আসনে শিক্ষকদের বসিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু থাকলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদাও পেতাম।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে নিয়ে যে নেতিবাচক কথা বলে, আমি মনে করি তার থেকে বড় মুর্খ এদেশে কেউ নেই। বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয় বাংলাদেশকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে মূল কারিগর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ বাংলাদেশের আমলা, রাজনীতিবিদরা, ব্যবসায়ীসহ সব সেক্টরে যারা শীর্ষস্থানীয় তারা সবাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের জ্ঞান গরিমা এবং পাণ্ডিত্ব দিয়ে অধ্যাপক হয়ে থাকেন। এটা নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন আমি মনে করি তাদের থেকে মুর্খ এদেশে আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদন্নোতি সম্বন্ধে এ ধরনের মতবাদ দেয়া এবং মন্তব্য করা আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সকলের প্রতি চরম অন্যায় এবং তাদের প্রতি অবিচার করার শামিল।
তিনি মনে করেন, এ জিনিসটা করতে পারে একমাত্র একটা মুর্খ। কোনো জ্ঞানী লোক, ভদ্র লোক, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এরকম মন্তব্য করতে পারেন না। এরকম করে থাকলে তিনি ওই জায়গায় বসার জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য।
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের চার হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার পর তিনি বলেন, কিছুই হয়নি! এরকম ঘটনার পর দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করতেই রাষ্ট্রীয় আসনে তিনি বসে আছেন।
সরকারপন্থি এই শিক্ষক নেতা বলেন, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য তার যে ভূমিকা আমি মনে করি এটা ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে থাকবে। যে লোক বলতে পারে- `ঘুষ খাওয়া ভালো কথা, কাজের গতি বাড়বে।` আমি মনে করি এটা দেশের জন্য কলঙ্ক, লজ্জা। এরশাদকে যেমনিভাবে দেশের মানুষ বিশ্ব বেহায়া বলছে তেমনিভাবে বর্তমানে বিশ্ব বেহায়া ও জাতির জন্য লজ্জা হচ্ছেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
পর্যালোচনা কমিটিতে আপনাদের কোনো সুপারিশ থাকবে কি-না জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ আবুল মালের মারাত্মক বিরোধিতা সত্ত্বেও বিষয়টি কেবিনেট স্যাব কমিটিতে গেছে। কেবিনেটে আমরা খবর পেয়েছি যে প্রথম থেকেই সে বিরোধিতা করে আসছিল এবং তিনি চাচ্ছেন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং মান মর্যাদার বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে বিষয়টাকে সেখানে পাস করে ফেলতে। কিন্তু তিনি পারেননি। কেবিনেটের যে সমস্ত সদস্য এখানে জোরালো ভূমিকা রাখছেন তাদের অভিনন্দন জানাই।
তিনি বলেন, অর্থ প্রতিমন্ত্রী টেলিভিশনে সরাসরি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, `আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে একটা সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছাবো, তারা খুব সম্মানীয়। তো আমি মনে করি না এটা খুব সমস্যা হবে।` তবে আমি বিশ্বাস করি এবং তাকিয়ে আছি তারা আমাদেরকে ডাকবেন। আমরা কথা বলবো। যখন কথা বলার সুযোগ পাবো তখন শিক্ষকরা যৌক্তিক কথা বলবে এবং আমরা ন্যায় সঙ্গত কথা বলবো অন্যায় কোনো আবদার আমরা করবো না। সরকারের সীমিত সম্পদের মধ্যে আমাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো আমরা পাবো এই আশা আমরা করি। অচিরেই আমরা একটা সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছাতে পারবো।
দাবি আদায়ে আপনাদের আন্দোলন চলমান থাকলে তার ধরনটা কী রকম হবে, জবাবে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্দোলনটা আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে। আমরা আমাদের সম্মানের জায়গায় কোনো ধরনের ছাড় দেবো না। আমাদের বেতন-ভাতার চেয়েও মুখ্য হলো আমাদের সম্মানের জায়গা। এখন আমাদের শিক্ষকরা অসম্মানিত হবে। শিক্ষাঙ্গনগুলো সরকারের এক দুইজনের আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু হবে তা শিক্ষকরা মেনে নেবে না। এ জায়গায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আছেন, ফেডারেশন আছে এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ আছেন, তাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে অন্যান্য শিক্ষকদের মতামত নিয়ে এবং সাধারণ সভা ডেকে সবার মতামত নিয়ে আমরা সামনের দিকে আমাদের পথচলাটা ঠিক করবো।
তিনি আরো বলেন, আমরা সব সময় আমাদের মাথায় রাখবো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার কথা খেয়াল রেখে গত চারমাসে মাত্র এক পূর্ণদিবস ক্লাস বন্ধ রেখেছি। আমরা আগামীতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা যেন বিঘ্নিত না হয়, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত না হয় সে জিনিসটা মাথায় রেখে আমাদের আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিটা হাতে নেবো।
বর্তমান সরকার অষ্টম পে-স্কেল অনুমোদন করেছে। আর আপনিও সরকার সমর্থিত প্যানেল থেকে শিক্ষক নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে আন্দোলনের বিষয়টি কি সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ছিল তা দেশের প্রথম গঠিত প্লানিং কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে রেখে প্রমাণ করেছেন।
তিনি বলেন, প্রফেসর মোজাফফর আহমেদকে বঙ্গবন্ধু শিক্ষামন্ত্রী করেছেন। ড. সেলিমকে তিনি শিক্ষা অধিদফরের অতিরিক্ত সচিব করেছেন। কবির চৌধুরীকে তিনি করেছেন শিক্ষা সচিব। তার যে রকম ভালোবাসা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও সে রকম ভালোবাসা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। তিনিও শিক্ষানুরাগী।
সরকার সমর্থিত এই শিক্ষক নেতা মনে করেন, বেতন-ভাতার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। এটার সঙ্গে সরকার-বিরোধিতার কোনো সর্ম্পক নেই। এটা কখনো সরকার-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেবে না। শিক্ষকদের মান-মর্যাদার ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রী দেখবেন। আমি মনে করি তার সময়ে আমাদেরকে কঠোর আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে হবে না। তিনি জিনিসটা চিন্তা করবেন। তার সুবিবেচনায় এটা যৌক্তিক একটা পরিণতির দিকে যাবে।
শিক্ষকরা তাদের মান-মর্যাদা ফিরে পাবেন। শিক্ষকদের মধ্যে এখন যে অশান্তি বিরাজ করছে এটা অল্প সময়ের মধ্যে দূর হবে। কারণ বিষয়টি যে স্থানে যে কমিটির হাতে দেয়া আছে আমি মনে করি সে কমিটি তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাদের ওপর আমাদের আস্থা আছে।
এমএম/এমএইচ/এসকেডি/বিএ