মেড ইন চায়না নয় মেড ইন বাংলাদেশের যুগ
যখন চীনা ব্যবসায়ী লিও ঝুয়াং লিফেং ২২ বছর আগে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন এই দেশের চিত্র ছিল ভিন্ন। এই ২২ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সে সময় বিমানবন্দরের সেবাও খুব বেশি উন্নত ছিল না। এমনকি লাইটও ঠিকমতো কাজ করছিল না।
লিও ঝুয়াং লিফেংয়ের বয়স এখন ৫১ বছর। তিনি ১৯৯৭ সালে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি দেয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। সে সময় শ্রম খরচ কম ও পর্যাপ্ত শ্রমিকের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় শুরু করেন তিনি।
ঝুয়াং বলেন, সে সময় ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব ছিল। এমনকি ইন্সট্যান্ট নুডলস কেনাটাও এতো সহজ ছিল না। বর্তমানে তার এলডিসি গ্রুপে কাজ করেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
ঝুয়াংয়ের কারখানাটি এত বড় যে তা দেখতে একটি গ্রামের মতো লাগে। সেখানে স্টাফ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনা পয়সায় সেবা দিতে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। এমনকি শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
বাংলাদেশের অনেক স্থানেই এখন এমন ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে চীন এবং অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরা এখানে আসা অব্যাহত রেখেছেন। এসব বিনিয়োগ এখন এই দেশকে উৎপাদনের ‘পাওয়ার হাউজে’ পরিণত করেছে।
এখানে ৩৫ লাখ শ্রমিক স্থানীয় ও ইউনিকলো, এইচঅ্যান্ডএমের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করছে। মাইকেল কোরসের মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পোশাকও এখন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। চীনে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় অনেক পোশাক প্রস্তুতকারকই আগামীতে ‘মেড ইন চায়নার পরিবর্তে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ ব্যবহার করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ঝুয়াং এখন বাংলাদেশে চাইনিজ এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। তিনি যখন প্রথম বাংলাদেশে পা রাখেন তখন মাত্র ২০ থেকে ৩০টি চীনা কোম্পানি এদেশে কাজ করতো। তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪শ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অপেক্ষাকৃত তরুণ দেশ। কিন্তু তারা দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
চীনা ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগ। কিন্তু চলতি বছর তা ৮ দশমিক ১৩ ভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদি তা অর্জিত হয় তবে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হবে অন্যতম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। এতে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছেন, অর্থনীতি শক্তিশালী থাকার কারণে এই ঋণ মোকাবিলা করতে সক্ষম বাংলাদেশ। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ এখন অন্য কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না।
হং কং এবং চীনের অনেক উদ্যোক্তার মতো এদেশে কারখানা গড়ে তুলেছেন চীনা ব্যবসায়ী ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং। শ্রম খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১০ বছর আগে নিজের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। তার মতো আরো অনেকে একই কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমাকে এশিয়ার যে কোনো স্থানে কারখানা সরিয়ে নিতে হয়েছিল। এটা শুধু বেতনের কারণে নয়, আমাদের দেশে শ্রমিকদের যে সামাজিক কল্যাণমূলক সুবিধা দেয়ার কথা তার মূল্যও অনেক বেড়ে যাচ্ছিল।
অনেকেই চীনে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করেছেন। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক। এক দশক আগে চীনের শেনঝেন, গুয়াংঝৌউ এবং কুনমিংয়ের মতো শহরে কারখানা ছিল ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই চোংয়ের। তিনি গুয়াংঝৌউয়ের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া অন্য কারখানাগুলোও সীমিত করা হয়েছে। বর্তমানে তার কোম্পানিতে যে পরিমাণ পরচুলা উৎপাদন হয় তার শতকরা ৯৩ ভাগই হয় বাংলাদেশে।
টিটিএন/এমএস