পুলিশের চোখে তিনি ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর খুনি
যুবলীগকর্মী ইমরানুল করিম খুনসহ অর্ধডজন হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল চট্টগ্রামের যুবলীগ ক্যাডার অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে। তার হাত থেকে রেহায় পায়নি তার খুব কাছের বন্ধুও, এতটুকু হাত কাঁপেনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বুকে ছুরি চালাতেও। বুধবার (২৯ মে) দিনগত রাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় খুন হয়েছেন সেই অমিত।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে কয়েদিদের মধ্যে মারামারিতে নিহত হন অমিত। ৩২ নম্বর সেলে রিপন নামের অপর এক কয়েদির ইটের আঘাতে অমিত গুরুতর আহত হন। এরপর তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের জেলার নাছির আহমেদ।
পুলিশের চোখে অমিত ছিলেন স্রেফ ঠাণ্ডা মাথার খুনি। অন্তত অর্ধডজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় এক ডজন চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও হত্যা মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট বাল্যবন্ধু ইমরানুল করিম ইমনকে খুনের পর ফের আলোচনায় আসে অমিত মুহুরীর নৃশংসতা।
জানা যায়, চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডা. মনোরঞ্জন মুহুরী চেয়ারম্যানবাড়ির অজিত মুহুরীর ছেলে অমিত মুহুরী। নগরের ওমর গণি এমইএস কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও তার গণ্ডি পেরোতে পারেননি। ছাত্রলীগ-যুবলীগ হয়ে ক্রমেই হয়ে ওঠেন পেশাদার খুনি।
২০১২ সালে নারীঘটিত বিষয় নিয়ে অমিত মুহুরীর সঙ্গে মারামারি হয় বন্ধু রাসেলের। পরে প্রতিশোধ নিতে অমিত মুহুরী তার সহযোগীদের নিয়ে রাসেলকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটায়। শুধু পিটিয়েই শেষ নয়, শরীরে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে রাসেলকে। নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর রাসেলের মৃত্যু হয়।
২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি সাত রাস্তার মোড় এলাকায় রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে খুন হয় শিশু মো. আরমান (৮) ও যুবলীগকর্মী সাজু পালিত (২৫)। চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের মামলায় অন্যতম আসামি অমিত মুহুরী। এরপর থেকে নগরের অপরাধ জগতে পাকাপাকিভাবে আলাদা জায়গা করে নেন তিনি।
বাসায় মরদেহ রেখে রাতভর গান শোনে অমিত
২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের এনায়েতবাজার রানীরদিঘি এলাকা থেকে একটি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে বোমা রয়েছে ভাবা হলেও ড্রাম কেটে ভেতরে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ গলে যাওয়ায় তখন পরিচয় বের করা যায়নি। পরে এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে একই বছরের ৩১ আগস্ট ইমাম হোসেন ও শফিকুর রহমান নামের দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে বলেন, ড্রামের ভেতরে পাওয়া মরদেহটি অমিতের বন্ধু নগর যুবলীগের কর্মী ইমরানুল করিমের। ৯ আগস্ট নগরের নন্দনকানন হরিশ দত্ত লেনের নিজের বাসায় ইমরানুলকে ডেকে নেন অমিত। এরপর বাসার ভেতরেই তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর অমিতকে কুমিল্লা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। সেই খুনে লোমহর্ষক বর্ণনা সে সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
জানা যায়, নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে বন্ধুকে খুনের পর তার মরদেহ বাথরুমে রেখে রাতভর গান শোনেন অমিত মুহুরী। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী চৈতী ও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব। গানের সঙ্গে চলে ইয়াবা সেবনের আসর। এর মধ্যে জোগাড় হয় এসিড, চুন, সিমেন্ট, বালি। ড্রামে মরদেহ ভরে এসিড ঢেলে গলানোর চেষ্টা হয়। এরপর তাতে চুন ঢেলে সিমেন্ট, বালি দিয়ে ঢালাই করা হয়। পরে ড্রাম ফেলে দেয়া হয় রানীরদিঘি পানিতে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিনকে দিনদুপুরে নগরের আমতলা এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অমিত মুহুরী জড়িত বলে দাবি সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতাদের। ওই ঘটনার মাত্র পাঁচদিন আগে ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বাকলিয়া এলাকায় মোটরসাইকেলে শোডাউন করে ত্রাস সৃষ্টি করে অমিত মুহুরী।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুল হকের পায়ে প্রকাশ্যে গুলি চালায় মুহুরী। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন নগরীর ডিসি হিলে পুলিশের ওপরও হামলা চালায় অমিত মুহুরী ও তার অনুসারী ক্যাডাররা।
আবু আজাদ/বিএ