নুসরাতকে পুড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দেয় জাবেদ পপি ও মনি
ফেনীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দেয় পাঁচজন। এর মধ্যে তিনজনই ছিলেন পরীক্ষার্থী। ওই দিন পরীক্ষা থাকায় এই ঘটনার পর পরীক্ষায়ও অংশ নেন তারা।
পিবিআই বলছে, রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার ও প্রত্যক্ষ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচজনের তিনজনই এই অপকর্ম শেষে হলে ঢুকে পরীক্ষা দেয়ায় পূর্বপরিকল্পনা বোঝা কঠিন ছিল।
মঙ্গলবার (২৮ মে) সকালে ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন, হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ও ফেনী আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে বুধবারই আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে। এতে ১৬ জনের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে পিবিআই।
বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলায় ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ ১৬ জন জড়িত। অভিযুক্ত সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, অভিযুক্ত ১৬ জনের মধ্যে এজাহারনামীয় আটজন। এজাহারের বাইরে তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় আরও আটজনকে অভিযুক্ত করে বুধবার চার্জশিট দাখিল করা হবে।
তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতারদের প্রত্যেককে একাধিকবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অভিযুক্ত এই ১৬ জনের মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় রাফি হত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা এবং জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
অভিযুক্ত ১৬ জন হচ্ছেন- এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০), রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।
বনজ কুমার বলেন, সার্বিক তদন্তে মামলার ঘটনার বিষয়ে জানা যায় যে, মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফির মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেফতার হলে তার অনুগতরা ক্ষিপ্ত হয়। ভয়ভীতি প্রয়োজনে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একাধিকবার বৈঠকও করেন তারা। হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নেয়ায় আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এর মধ্যে শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। কাউন্সিলর মাকসুদ শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা দেয়। শাহাদাত পরিকল্পনা মোতাবেক দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুটি বোরখা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনায়।
পরবর্তীতে ৩ এপ্রিল শাহাদাত নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা এবং এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
৪ এপ্রিল পরিকল্পনা মোতাবেক মাদরাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরুউদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহারসহ আরও কয়েকজন নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পরদিন ভূঁইয়া বাজার থেকে শাহাদাত এক লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রাখে। ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায় শাহাদাত নুরউদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদরাসা প্রাঙ্গণে আসে এবং পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে যে যার মতো অবস্থান নেয়। শাহাদাত পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়।
কামরুন্নাহার মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি মোট তিনটি বোরখা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের বোরখা ও হাত মোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বে অবস্থান করা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে।
নুসরাত ২য় তলায় পৌঁছালে উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়, নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে উঠলে আসামি কামরুন্নাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে।
তখন নুসরাত অস্বীকৃতি জানালে শাহাদাত বাম হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে নিয়ে আসে। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে সে ওড়না দুভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পিছনে বেঁধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে আসামি জোবায়ের পা পেঁচিয়ে ফেলে, জাবেদ পায়ে গিট দেয়। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। কামরুন্নাহার মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং উম্মে সুলতানা পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে, এরপর উম্মে সুলতানা পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ওই সময় পূর্বের শিখানো মতে কামরুন্নাহার মনি উম্মে সুলতানা পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়।
কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলে। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরখা দিয়ে নিজেও পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করে।
শাহাদাত হোসেন শামীম নেমে মাদরাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় ও মাদরাসার পুকুরে বোরখা ফেলে দেয়। আসামি জোবায়ের সাইক্লোন শেল্টার থেকে নেমে মাদরাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরখা ও হাত মোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়।
নুর উদ্দীন সাইক্লোন শেল্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে। মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন শেল্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারা দেয়। মাদরাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারা দেয়। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর সবাই নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।
বনজ কুমার বলেন, নুসরাত রাফি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসার সময় দুঃখজনক হলেও সত্য যে শরীরে কাপড় দেখা যায়নি। পুড়ে গেছে। শরীর থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছিল। গেটে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। হত্যায় জড়িত নুরউদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদেরও রাফির গায়ে পানি দেয় এবং ভাই নোমানকে ফোনে খবর দেয়।
বনজ কুমার বলেন, ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণি পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী। খুনের পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষাও যে দেয়া সম্ভব তা ভাবনাতীত। এ ঘটনা শিক্ষণীয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জেইউ/এমএমজেড/এমএস