‘বালিশ-কেটলির’ উপাখ্যান যেন ‘হিমশৈলের চূড়া’ না হয় : টিআইবি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটি বুধবার এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি এই প্রকল্পের সর্বাঙ্গীণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্প নিয়ে নানামুখী বিতর্ক থাকার পরও তা সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু শুরুতেই ক্ষুদ্র একটি অংশে যে ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তাকে আমরা এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সেখানে মাত্র ২৫ কোটি টাকা খরচের ক্ষেত্রেই যে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে টিআইবি বলছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়মের মাত্রা ‘সাগরচুরিসম’। তবে এ ধরনের সরকারি প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়।
আলোচিত এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্পটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত চলছে জানিয়ে দুদক ‘ধীরে চলো’ নীতি ঘোষণা করেছে। এতে আমরা শঙ্কিত।
‘বালিশ-কেটলির’ উপাখ্যান পুরো প্রকল্পে সম্ভাব্য অনিয়মের যেন ‘হিমশৈলের চূড়া (টিপ অব দ্য আইস বার্গ)’ হিসেবে প্রতীয়মান না হয়, সেজন্য দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার’ নীতির যথাযথ প্রতিফলনের দাবি জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
আরও পড়ুন>> বালিশ দুর্নীতির তদন্তে রূপপুর যাবে আইএমইডি
সম্প্রতি নির্মাণাধীন দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিন সিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া দুর্নীতির চিত্র অনুযায়ী, একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি টাকায় আকাশসমান দামে এসব আসবাবপত্র কেনার পর তা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে তুলতে অস্বাভাবিক হারে অর্থ ব্যয়ের এ ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতরের পাবনা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা। শুধু আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে ওঠাতে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। নথিপত্র ঘেঁটে এমন তথ্যই উঠে এসেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে একটি সংবাদপত্র।
জানা গেছে, প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা দরে ১১০টি খাট কিনতে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টাকা। খাটগুলোর প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটে নিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা। একেকটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকা, ভবনে ওঠাতে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকা দরে কেনা সেন্টার টেবিলের প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৪৮৯ টাকা।
কেজিখানেক ওজনের একটি বৈদ্যুতিক কেটলি নিচ থেকে ফ্ল্যাটে তুলতেই খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। একই রকম খরচ দেখানো হয়েছে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেক্ট্রিক আয়রন ওপরে তুলতে। প্রায় আট হাজার টাকা করে কেনা প্রতিটি বৈদ্যুতিক চুলা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে খরচ দেখানো হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকার বেশি। ঘুমানোর জন্য প্রতিটি বালিশ ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা করে। আর একেকটি ওয়াশিং মেশিন ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে ওয়াশিং মেশিনসহ অন্তত ৫০টি পণ্য ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক, কোনো কোনোটিতে ৭৫ শতাংশ।
অস্বাভাবিক এই অর্থ ব্যয় কেবল ভবনে ওঠানোর ক্ষেত্রেই নয়, আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে। প্রতিটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে। এ হিসাবে ৩৩০টি চাদর কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকায়। ৩৩০টি বালিশের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে কাছাকাছি ব্যয়। কাপড় পরিষ্কারের জন্য ১১০টি ওয়াশিং মেশিনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা করে। ১১০টি টেলিভিশনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায় এবং সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে।
এইচএস/এসআর/এমকেএইচ