উচ্চ ফলনই কৃষকের গলায় ফাঁস!
রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক ধান ও গমসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে দেশের ১৬ কোটি মানুষের অন্ন জোগায়, তাদের ফলানো অতিরিক্ত ফসলই এখন তাদের ‘গলায় ফাঁস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষকরা যে পরিমাণ কায়িক শ্রম ও টাকা-পয়সা খরচ করে জমিতে ধান ফলান সেই অনুপাতে ধানের দাম পাচ্ছেন না। ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় চোখে সরষের ফুল দেখছেন লাখ লাখ কৃষক।
জানা গেছে, কৃষকদের অনেকেই ঋণ করে জমিতে ধান উৎপাদন করেছেন। এখন ফসল ওঠায় পাওনাদাররা তাদের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছেন। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে সিলেটে বন্যার কারণে চালের ঘাটতি দেখা দেয়ায় চাল আমদানিকারকরা অতিরিক্ত চাল আমদানি করেন। ওই সময় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল আমদানি যথেষ্ট থাকলেও মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা ৩৯ লাখ টন চাল আমদানি করেন। ২০১৭ সালে আমদানি করা চাল এখন পর্যন্ত বিক্রি শেষ হয়নি।
এছাড়া গত মৌসুমে বোরো ও আউশের উৎপাদন ভালো হয়েছে। আমনের টার্গেট এক কোটি ৪০ লাখ টন থাকলেও উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ টন অর্থাৎ ১৩ লাখ টন চাল অতিরিক্ত উৎপাদন হয়। আলু উৎপাদনের টার্গেট ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন থাকলেও উৎপাদন হয় এক কোটি তিন লাখ টন অর্থাৎ ৩৩ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়। এছাড়া বছরব্যাপী বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের কারণে গুদামে মজুদ থাকে। আগের ফসল মজুদ থাকায় ধানের দাম এবার কমে গেছে।
কৃষকদের দুরাবস্থা থেকে উদ্ধারে সরকারেরও এ মুহূর্তে তেমন কিছু করার নেই বলে মন্তব্য করেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। অস্বাভাবিকহারে ধানের দাম কমে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও খুবই চিন্তিত এবং সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চ মহলে প্রচেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেন। বলেন, এ মুহূর্তে বিদেশে ধান ও চাল রফতানির চিন্তাভাবনা চলছে। তবে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আমদানিকারক দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি হঠাৎ করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে তখন খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে- এ বিষয়টিও মাথায় রাখা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার চাইলেও কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে পারবে না। কারণ দেশে বার্ষিক ফসল উৎপাদন হয় সাড়ে তিন কোটি টন। সরকারিভাবে মাত্র ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। গত বছরের উৎপাদিত ফসলের প্রায় ১০ লাখ টন এখনও সরকারি গুদামে রয়ে গেছে। সুতরাং এ মুহূর্তে সরকারিভাবে ধান কিনলেও ১০ লাখ টন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
এছাড়া সঠিক কৃষক চিহ্নিত করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তিনি ইতোপূর্বে খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি। কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কৃষক সাজিয়ে ধান বিক্রি করেন। এ কারণে প্রকৃত কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না।
তিনি আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারিভাবে সব ধরনের পণ্য কিনে মজুদের ব্যবস্থা থাকায় কৃষকরা ন্যায্য মূ্ল্য পান। একসময় দেশে চালের চাহিদা সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে একই জমিতে বছরব্যাপী একাধিক ফসল উৎপাদন হওয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের দেশে পরিণত হয়। কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান বা চাল কিনতে হলে সরকারিভাবে শতভাগ গুদামজাতকরণের সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এমইউ/এমএআর/পিআর