রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় বাংলাদেশ
রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যকার মতানৈক্য কমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চাইছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে শক্তিশালী এ দেশটির কাছে বিভিন্ন উপাত্ত তুলে ধরা হচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্বল্প পরিসরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করার বিষয়টিও ভাবছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরো রোহিঙ্গা সংকটে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত এ কারণে ভাসানচরের বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি যে, ভাসানচরে ইতোমধ্যে দ্বীপ রক্ষা বাঁধ, সাইক্লোন আশ্রয়স্থল, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ রোহিঙ্গাদের বেশ ভালো থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সেখানে স্বল্প পরিসেরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও পাবে রোহিঙ্গারা।’
মিয়ানমারের সেনা নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করছে। সরকার সেখান থেকে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সাময়িকভাবে স্থানান্তর করতে চায়। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানালেও এ বিষয়ে আরও তথ্যের জন্য অনুরোধও করেছে জাতিসংঘ।
এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে শক্ত সমর্থন দেয়া দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভাসানচরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার স্থানান্তরের জন্যও সহযোগিতা আশা করছে বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, মিয়ানমারের তৈরি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। এটি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং এ সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া জরুরি। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহযোগিতা করেছে, যার জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। আর ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ আরও বেশি রাজনৈতিক ও অর্থিক সহযোগিতা আশা করে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় ও রোহিঙ্গাসহ মোট ১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য ৯৫ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থায়নের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ, সাড়ে ৬৫ কোটি ডলার সহযোগিতা জোগাড় হয়েছে। আর এ অর্থের সিংহভাগ ৩৬ শতাংশ, ২৪ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র একাই। আর ২০১৯ সালের জেআরপি অনুযায়ী ৯২ কোটি ডলারের চাহিদার জায়গায় চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৬ শতাংশ বা প্রায় ১৫ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছে। এখানেও ১০ কোটি ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যা বর্তমান জোগাড়কৃত অর্থের ৭১ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আহ্বান সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা চালিয়ে যেতে ২০১৯ সালে প্রকাশিত জেআরপিতে ভাসানচরকে অন্তর্ভুক্ত করনি জাতিসংঘ। সংস্থাটি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করতে হলে তাদের পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত এবং জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই জাতিসংঘের নেতৃত্বে জয়েন্ট রেসপন্স প্লানে (জেআরপি) ভাসানচরকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সেই মোতাবেক ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের বিষয়টিতে নমনীয় হয়েছে। আর এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ভাসানচরে বিষয়ে জাতিসংঘ সরকারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকতে চায়। ভাসানচরে শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ ও টেকসই বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করতে, গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা এবং কার্যপরিচালনা-সংক্রান্ত যেসকল বিষয় স্থানান্তর শুরু হওয়ার পূর্বেবিবেচিত হওয়া উচিত সে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ।
ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয় জানায়, শরণার্থীরা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হতে রাজি হলে, ওই স্থানান্তরের কার্যপদ্ধতি, বসবাসের জন্য প্রদত্ত পরিবেশ এবং যে সকল মৌলিক অধিকার ও সেবাসমূহ তারা পেতে পারে, পাশাপাশি ওই দ্বীপে প্রশাসন-সংক্রান্ত বিষয় এবং জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার কেমন হবে এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে সংস্থাটির।
ভাসানচরে শরণার্থী স্থানান্তরের কার্যকারিতা এবং ওই দ্বীপে মানবিক সেবা কার্যক্রম স্থাপনের সম্ভব্যতার যাচাইয়ের জন্য ওই দ্বীপের কারিগরি সমীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মূল্যায়ন করা এবং সতর্ক পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানানো হয়। ভাসানচরে মানবিক সেবা কার্যক্রম স্থাপনে সম্ভাব্য যে সকল কার্য-পরিচালনা-সংক্রান্ত প্রভাব পরতে পারে জাতিসংঘ সেটাও যাচাই করছে। পাশাপাশি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় দিকসমূহ, সময়সীমা এবং খরচও যাচাই করছে।
জাতিসংঘ চায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাবে এবং এ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাসঙ্গিক, সঠিক ও সময়োপযোগী তথ্য শরণার্থীদের কাছে থাকতে হবে। যাতে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আলোচনাভিত্তিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শরণার্থীদের মতামত এবং উদ্বেগগুলোকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেপি/এমবিআর/জেআইএম