নাসা-কিন্ডার মর্গ্যান ছেড়ে তিনি এখন বাংলাদেশে
আকাশসম স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- নাসায়ও যোগ দিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেকটা ভারী করে দেশটির বৃহত্তম জ্বালানি প্রতিষ্ঠান কিন্ডার মর্গ্যানে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। দায়িত্ব পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠানে।
তবে থিতু হতে পারেননি প্রবাস জীবনের সেই স্বপ্নধারায়। হবেন-ই বা কী করে! মাতৃভূমিকে যিনি ‘মা’ জানেন তিনি তো আর নাড়ির টান ভুলে থাকতে পারেন না। বিত্ত-বৈভবের সব হিসাব চুকিয়ে অবশেষে চাকরি নিলেন বাংলাদেশেরই একটি প্রতিষ্ঠানে।
আরও পড়ুন >> বাংলাদেশে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঈর্ষণীয়
প্রকৌশলী আজাদুল হক। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাক্স’ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও, পাওয়ার)। সম্প্রতি এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘ব্রেইন ড্রেইন নয়, এখন আমরা ব্রেইন রিচ করতে চাই।’ চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের শান-শওকত ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে নিজেই সেই প্রতিশ্রুতির প্রমাণ দিলেন।
ম্যাক্স গ্রুপে যোগদানের প্রতিক্রিয়ায় আজাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমেরিকায় থাকতাম বটে। তবে হৃদয় তো বাংলাদেশেই পড়ে থাকত। এর আগেও বহুবার এসেছি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। মূলত দেশকে কিছু দেয়ার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়াস ছিল। এখন কিছু দিতে পারা দায়িত্ব বলে মনে করছি।’
‘সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশ এখন প্রস্তুত। দিনবদলের সারথি হতে পারাটাও সৌভাগ্যের বটে।’
বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকাতেই। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে স্বপ্নযাত্রা শুরু। ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮২ সালের কথা। কিন্তু দিগন্ত প্রসারিত করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। সেখানে পড়াকালীন চাকরি করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ওই সময় রিটেইল বিজনেস নামের একটি কম্পিউটার কোম্পানির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব (গ্রিন কার্ড) পাওয়ার পর ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে যোগ দেন। মূলত আজাদুল হক-ই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবের মূল অবকাঠামো দাঁড় করান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ কিসলুর সঙ্গে বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত মিডিয়া কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ওই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক ব্যানার-ফেস্টুন তৈরির যাত্রা।
আরও পড়ুন >> সারাবিশ্বের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট খোঁজে
১৯৯৮ সালে ফের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। যোগ দেন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান- নাসায়। প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি সেখানে ডিজাইনের কাজেও যুক্ত হন। এর আগেও তিনি গ্রীষ্মকালীন সময়ে নাসায় পার্টটাইম কাজ করেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত। উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘ফোবানা’র সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এর আগে তিনি ফোবানার টানা চার বছর সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে আয়োজিত বিশ্ব প্রযুক্তি মেলায় অংশ নিয়ে সাইবার সিকিউরিটির ওপর বক্তব্য দেন। একই সময়ে বাংলাদেশে আয়োজিত অন্যান্য সেমিনারেও প্রযুক্তিবিদ হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ‘বিজ টু বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর এক সেমিনারে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আর ব্রেইন ড্রেইন নয়, ব্রেইন রিচ (মেধা পাচার নয়, মেধা সমৃদ্ধ) করতে চাই’।
এরপর থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নজরে আসেন আজাদুল হক। প্রস্তাব আসে বাংলাদেশের অন্যতম নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও, পাওয়ার) পদের। চলতি মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ জ্বালানি প্রতিষ্ঠান কিন্ডার মর্গ্যান ছেড়ে ম্যাক্স গ্রুপে যোগ দেন তিনি।
ম্যাক্স গ্রুপে যোগদানের আগে আজাদুল হক তার ফেসবুক পেজে দেয়া এক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘সব বিত্ত, সব প্রাচুর্য, সব আরাম, আয়েস ছেড়ে আবার চলে এলাম তোমার কাছে। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, আমি ম্যাক্স গ্রুপের (পাওয়ার) সিইও হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করতে আসছি এই এপ্রিল মাস থেকে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই অল্প কিছুদিন আগে ‘কোন’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘আমরা ব্রেইন ড্রেইনকে করব ব্রেইন গেইন, কারণ আমরা বাংলাদেশকে করতে চাই ব্রেইন রিচ’। তারই ফলশ্রুতিতে আমি নিজেই নিলাম প্রথম সাহসী পদক্ষেপ।
কোনো কাজ অন্যকে করতে বলার আগে নিজে করে দেখানোটাই শ্রেয়।
বাংলাদেশের জাতীয় অবকাঠামোতে সরাসরি নিজের শ্রম, মেধা আর অভিজ্ঞতা সামান্য হলেও যে কাজে লাগাতে পারব, তাতেই আমি ধন্য। ধন্যবাদ ম্যাক্স গ্রুপকে সম্মানের সাথে আমাকে তাদের পরিবারে সম্পৃক্ত করে নেয়ার জন্য।
এ বাংলাদেশ আর আগের বাংলাদেশ নয়। এ এক নতুন বাংলাদেশ, এক দৃঢ়, প্রত্যয়ী, সাহসী বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন >> অদম্য বাংলাদেশে অবাক বিশ্ব
যেন বাংলাদেশের কাজে পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে, সিইও হিসেবে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করতে পারি, যেন সম্মান বাড়াতে পারি বাংলাদেশের, যেন কষ্টে অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা দিয়ে ম্যাক্স গ্রুপকে করতে পারি আরও অনেক সফল; সেজন্য আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন।’
জাগো নিউজের কাছে প্রতিক্রিয়ায় আজাদুল হক আরও বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে এক ঝড় দেখতে পাচ্ছি। উন্নয়নের ঝড়। এই ঝড়ে শামিল হওয়া আমার মতো মানুষের কাছে ঈর্ষাও বটে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এখন বাংলাদেশে আসা যায়। বাংলাদেশ বিশ্বখ্যাত প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদদের এখন ধারণ করতে পারে। এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের মহাসড়কে হেঁটে নিজেদের সমৃদ্ধ করারও সময় এসেছে এখন।’
এএসএস/এমএআর/এমএস