থাইগ্লাসে ‘মৃত্যুকূপে’ পরিণত হয়েছিল এফআর টাওয়ার
>> কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা থাকতে হবে
>> সবার সচেতনতা দরকার, দায়িত্বও সবাইকে নিতে হবে
>> এক নম্বর ক্যাবল পাবেন না, বিক্রিই শুরু হয় ১০ নম্বর দিয়ে
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেছেন, বহুতল ভবন করলে ক্যাটাগরি ভিত্তিতে করেন। সবচেয়ে নিম্ন বহুতল ভবনের ক্ষেত্রেও ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিজস্ব ফাইটার থাকতে হবে। কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিজের ইকুইপমেন্ট দিয়ে ফাইটিংয়ের ক্ষমতা থাকতেই হবে। এটাই স্ট্যান্ডার্ড।
রোববার (৩১ মার্চ) রাজধানীর কলাবাগানের ইয়াকুব সাউথ সেন্টারে স্টেট ইউনিভার্সিটি আয়োজিত ‘অগ্নিকাণ্ড : কারণ ও করণীয় শীর্ষক' গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, যদি মডারেট সিস্টেমে যান তবে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস আসার আগে ৪৫ মিনিট আপনাকে ফাইটিং করার ইকুইপমেন্ট ও ফাইটার জনবল থাকতে হবে। ওই রকম প্ল্যান থাকতে হবে, পানির সাপ্লাই থাকতে হবে। যদি হাই হ্যাজার্ড (বহুতল) বলেন, তাহলে ৭৫ মিনিট ফাইটিংয়ের সক্ষমতা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, `আমরা সবাই বলি অমুকের দোষ, কিন্তু স্বপ্ন দেখায় কে? অর্থাৎ প্ল্যানার কে? বাস্তবায়ন করে কারা? আর্কিটেক্ট, ডিজাইনার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, গ্যাস; কিন্তু কারও সঙ্গে কারও কোনো সমন্বয় নেই।'
‘আমার কাছে দেশের সব ভবনের ডিজাইন আছে। আমি ডিজাইন ধরে ধরে বড় বড় ডিজাইনারদের ডেকেছিলাম। বলেছি, এ ডিজাইন কীভাবে সাইন করলেন? এটা কীভাবে সম্ভব? তখন তারা বলেন, এটা তো আমি করিনি, নতুন ছাত্রকে দিয়ে করিয়েছিলাম। এটাই আমাদের কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকার অর্থে সবার সচেতনতা দরকার। দায়িত্বও সবাইকে নিতে হবে।’
বনানীর আগুন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তদন্তে দেখা যায়, একটি লাইনের ভেতরেই সব লাইন। বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাসলাইন, ইন্টারনেট, টেলিফোন, সুয়ারেজ- সব একসঙ্গে প্লাস্টিকের পাইপের ভেতরে। গ্লাস লাগিয়ে ডেকোরেশন করে একরকম মৃত্যুকূপ বানানো হয়েছিল।’
তিনি বলেন, সব ডেকোরেশন গ্লাস দিয়ে বানানো। গ্লাস তো হিট বেশি করে। এফআর টাওয়ারে একটি মাত্র সিঁড়ি। ধোঁয়া বের হতে পারেনি গ্লাসের কারণে। ৮, ৯ ও ১০ তলায় আমি নিজে ফাইট করেছি। তাপমাত্রা ছিল দুই হাজার সেন্টিগ্রেড। সেখানে একটানা পাঁচ মিনিট কাজ করা ছিল কঠিন। ফাইটার চেঞ্জ করে জীবনবাজি রেখে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। কেমিক্যাল আইটেম তো ছিলই। চারতলায় এসে একমাত্র সিঁড়িকে কেটে বানানো হয়েছে ঘর।’
‘বনানীর আগুনের ঘটনা আমাদের দেরিতে জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিস যখন বের হয় তখন পথে দীর্ঘ যানজট। সেটা অতিক্রম করে পৌঁছতে আরও ১০-১৫ মিনিট দেরি। এসে দেখি পুরো বিল্ডিং জ্বলছে। অনেকে বলেন, আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। আমাদের সবই আছে। বুর্জ খলিফা ১০০ তলা। এজন্য কি আপনি এখন ১০০ তলা কাভার করার মতো ব্যবস্থা নেবেন?’
‘আমাদের সমস্যা, সবাই নীতিকথা বলি, সবাই এক্সপার্ট। কিন্তু রাস্তা কেন সরু, পানির সাপ্লাই কেন নেই। লেখা থাকে, বাড়ি ব্যবস্থা নিলাম। গিয়ে দেখি কেমিক্যাল কারখানা। এর দোষও কি ফায়ার সার্ভিসের?’
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস জেনে না জেনে, না বুঝে অনেক কাজ করে। আমরা পাখি উদ্ধার করি, বিড়াল উদ্ধার করি, গরু উদ্ধার করি। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, মারামারি করলেও তাদের উদ্ধার করতে হয়। আমি আগুন নেভাই, ফায়ার ফাইটিং করি, কেমিক্যাল ফায়ারিংয়ে যেতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনাতেও যেতে হয়। আমি কোন কাজটা করি না? এমনই একটি বিভাগ ফায়ার সার্ভিস, যাদের কল করলেই পাবেন। আর আমি বেশি কাজ করি বলেই বেশি সমালোচনা?
‘এসব ডিজাস্টার (বিপর্যয়) ম্যানেজ করতে হলে শুধু ফায়ার সার্ভিসকে দিয়ে সম্ভব নয়। সবারই ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা দরকার। যে ভবনে বসে আছি, এখানে চেয়ারে কি নাম্বারিং আছে, স্মোক হিট ডিটেক্টর আছে? পেছনের দরজাও লক করা। এটা কিন্তু নরমাল সিনারিও। সত্যিকার অর্থে, আমাদের ম্যানেজমেন্ট সেফটি অ্যারেঞ্জমেন্টের কালচার ডেভেলপ করতে হবে।’
ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, বিল্ডিং কোড দেখে মাথা ঘুরে যাবে। এটা বোঝার অবস্থায় নেই। এটা দেখে মনে হবে, দেশের অবস্থা দেখে বিল্ডিং কোড তৈরি করা হয়নি। আমাদের দেশের মানুষের চরিত্র ও অবস্থা দেখে কেন এটা করা হলো না?
‘আমার দেশে এক নম্বর জিনিস পাওয়াই কঠিন। দেশের ৭০/৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ইলেক্ট্রিক শর্টসার্কিট থেকে। কিন্তু আপনি পুরান ঢাকায় যান, এক নম্বর ক্যাবলই পাবেন না। বিক্রি শুরুই হয় ১০ নম্বর দিয়ে। কম মূল্য থেকে বিক্রি শুরু। এটা পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাবেন না। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।’
তিনি বলেন, আমি নিজেই মারা যাচ্ছিলাম গাজীপুরে, ২০১৫ সালে ডিগনিটি গার্মেন্টসে। ভবনটি হুরমুড় করে ভেঙে পড়ে। আমি পাশেই ছিলাম।
স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন স্থপতি অধ্যাপক শামসুল ওয়ারেসের সভাপতিত্বে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
এছাড়া অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান ড. নাসরিন হোসাইন, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমান, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাত খান, বাংলাদেশ এসিড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ পলাশ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. কামরুজ্জামান মজুমদার, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, ঢাবির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আহসান হাবিব সানা, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জেইউ/আরএস/এমএআর/আরআইপি