ত্রুটিপূর্ণ এফআর টাওয়ারে বিভ্রান্ত হন উদ্ধারকর্মীরা
বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মোট ২৫ জন নিহত হন। আহত হন ১২০ জন। তাদের মধ্যে ৫৬ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
ভবনে সুসংগঠিত আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে হতাহতের সংখ্যা এত হতো না বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, আগুন লাগলে যা যা প্রয়োজন তার প্রায় সবই ছিল এফআর টাওয়ারে। তবে এগুলোর কোনোটিই কার্যকর ছিল না। ভবনের একমাত্র ইমার্জেন্সি এক্সিট (জরুরি বহির্গমন পথ) অপরিকল্পিত ও অপরিপক্ব ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।
ত্রুটিপূর্ণ ইমার্জেন্সি এক্সিট
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ভবনে যে ইমার্জেন্সি এক্সিট ছিল, সেটা এমন ছিল যে, সেটা দিয়ে মানুষ বের হলে আরও বিপদে পড়তেন। অধিকাংশ মৃতের ঘটনা ইমার্জেন্সি এক্সিটের সিঁড়িতে হয়েছে। সিঁড়ির লবি এবং সিঁড়ি থেকে মোট ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে তিনজন সম্পূর্ণ পুড়ে যান।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল জাগো নিউজকে বলেন, গতকালের ঘটনায় কিছু মানুষ লাফ দিয়ে মারা যান। বাকিরা সবাই ধোঁয়ার কারণে। এরপর আগুনে পুড়ে যান। স্মোক ম্যানেজমেন্টের (ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ) বিষয়টা এফআর টাওয়ারসহ কোনো ভবনই ফলো করে না। নিয়ম হচ্ছে, ইমার্জেন্সি এক্সিটের সিঁড়িতে বন্ধ (ভরাট) দরজা থাকতে হবে, এটা কাঁচ বা কাঠের হতে পারে। যাতে ধোঁয়া সিঁড়িতে না যেতে পারে। কিন্তু এফআর টাওয়ারের ফায়ার ডোরটি গ্রিল দিয়ে তৈরি। ফলে সিঁড়িতে ধোঁয়া গেছে এবং এ কারণে অনেকে মারা গেছেন। এ ভবনের ইমার্জেন্সি সিঁড়ি ব্যবহারযোগ্য ছিল না।
ভবনে নম্বরপ্লেট ছিল না
এফআর টাওয়ারে হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ভবনের কোনো ফ্লোরে নম্বরপ্লেট না থাকা। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, ভবনের সিঁড়ির সামনে, লিফটের সামনে অথবা দুই সিঁড়ির মাঝামাঝি করিডরে প্রথম তলা/লেভেল-১, লেভেল-২ ইত্যাদি লেখা থাকার কথা। কিন্তু এ ভবনে তা ছিল না।
উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ভবনটিতে উঠে কয়েকজন আহতকে একসঙ্গে দেখতে পান। এরপর ওয়ারলেসে এখানে আরও কর্মকর্তা পাঠানোর অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু কেউই জানতেন না যে, তারা কততম ফ্লোরে রয়েছেন, তাই তাদের ওই ফ্লোরে যেতে বেগ পেতে হয়। তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে গুনে গুনে সংখ্যা বলতে হয়েছে। এতে হতাহতদের উদ্ধারে বেশি সময় লাগে।
ত্রুটিপূর্ণ পাঞ্চিং মেশিন
কর্মকর্তারা জানান, এফআর ভবনের যেসব ফ্লোরে আগুন লেগেছে এর প্রতিটি অফিসের গেটই এক্সেস কন্ট্রোল বা পাঞ্চিং মেশিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। অর্থাৎ কর্মীরা নিজেদের আইডি কার্ড পাঞ্চ করলে গেটটি খোলার কথা। এছাড়া যদি ভবনের বিদ্যুৎ চলে যায় কিংবা ইমার্জেন্সি সময়ে দরজাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাওয়ার কথা। তবে আগুনের পর যখন ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, তখন গেটটি খোলেনি। অনেকে নানাভাবে দরজা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এতে তাদের আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়।
নিষ্ক্রিয় ছিল হোস পাইপ, ছিল না পানি
ভবনটি পরিদর্শন শেষে খন্দকার আবদুল জলিল জাগো নিউজকে বলেন, আগুন লাগার সময় আমরা এফআর ভবন থেকে পানি নিতে পারিনি। ভবনের হোস পাইপগুলো ইনঅ্যাক্টিভ (নিষ্ক্রিয়) ছিল, তাই পাশের ভবন থেকে পানি নিতে হয়েছে।
ফায়ার ফাইটার ছিল না
বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, প্রতিটি ভবনের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং টিম থাকবে, যারা ভবনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন। কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নির্বাপণ করবে। কিন্তু এফআর টাওয়ারে এমন কোনো ফায়ার ফাইটার দেখেননি ফায়ার সার্ভিসের কেউ।
ভবনের ১৩ তলা থেকে উদ্ধার হওয়া আবু হোসেন শুক্রবার জাগো নিউজকে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমরা আগুনের খবর পাই। কিন্তু তখন কোনো অ্যালার্ম বাজেনি। ফায়ার অ্যালার্মটা আগে থেকেই নষ্ট ছিল। এছাড়া আমাদের মধ্যে অনেকেই উপরের ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন, ছাদের গেট তালাবদ্ধ। তাই তারা আবার নেমে আসেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার লাগা বনানীর ওই আগুনে নিহতের সংখ্যা ২৫ জন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ। ওই ঘটনায় মোট আহত হয়েছেন ১২০ জন। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৫৬ জন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণের পর অন্যরা হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
এআর/জেইউ/এমএআর/পিআর