বাকশাল ছিল জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্লাটফর্ম : প্রধানমন্ত্রী
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে জাতীয় ঐক্য হবে।’
সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত স্বাধীনতা পদক-২০১৯ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) এমন একটা ব্যবস্থা করেছিলেন যে, বাহাত্তরের সংবিধান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেহাত্তরে নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগও জয়লাভ করে। মাত্র ৯টি সিট তখন আওয়ামী লীগের বাইরে অন্যরা পেয়েছিলেন। তারপরও তিনি (বঙ্গবন্ধু) অন্য রাজনৈতিক দলগুলো, যারা কখনো নির্বাচনে হয়তো জয়ী হতে পারে না তাদের সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে জাতীয় ঐক্য হবে। ঐক্যের মধ্য দিয়ে সবাই দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। সেখানে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে। অর্থাৎ প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী থেকে শুরু করে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে এসে একটা প্লাটফর্ম দাঁড় করিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে তিনি কাজ করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরেও যারা পরাজিত শক্তি তাদের দোসর, আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করা; সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা মূলত এমন কিছু ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালায় যেটা তাকে (বঙ্গবন্ধু) কঠোরভাবে সামাল দিতে হয়েছে। আবার সেই সঙ্গে যেসব আন্তর্জাতিক শক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল আমরা যাতে স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারি, তাদের চক্রান্ত কিন্তু থেমে যায়নি।’
তিনি বলেন, তাদের এই চক্রান্তের ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ হয়, দেশের অর্থনীতির ওপর আঘাত আসে, পাটের গুদামে আগুন, থানা লুট করা থেকে শুরু করে আমাদের আওয়ামী লীগের প্রায় সাতজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকেও হত্যা করা হয়। এমন একটি অবস্থার মাঝে জাতির পিতা সিদ্ধান্ত নেন, যে করেই হোক আমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। দেশের উন্নয়ন বাড়াতে হবে এবং দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেই চিন্তা থেকে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ যেটাকে সংক্ষিপ্ত আকারে বাকশাল নামে পরিচিত করা হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল সব দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে অর্থনৈতিক মুক্তির অর্জনটা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্য নিয়ে তিনি স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার জন্য আমাদের যতগুলো মহকুমা ছিল সেই মহকুমাগুলোকে তিনি জেলায় রূপান্তর করেন। আমাদের মাত্র ১৯টি জেলা ছিল, সেখানে তিনি ৬০টা জেলা করেন।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী যারা, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে এবং তাদের যে দোসর। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের যে সমর্থক, তাদের মধ্যে একটা বিরাট চক্রান্ত কাজ করেছিল। যখন তারা দেখলো এর ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হবে, স্বাবলম্বী হবে আর বাংলাদেশকে কখনো থামিয়ে রাখা যাবে না- ঠিক তখনই তারা তাদের চক্রান্ত শুরু করলো।’
তিনি বলেন, জাতির পিতার উদ্যোগটা ছিল যে, জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা এবং যার শুভ ফলটা কিন্তু মানুষ পেতেও শুরু করেছিল। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৭ ভাগ অর্জন হয়েছিল ওই পঁচাত্তর সালের অর্থবছরে। বাংলাদেশ খাদ্যের ঘাটতি শুধু নয়, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির যাত্রাও শুরু হয়েছিল। তারা দেখলো গণহত্যা করে বাঙালিকে ঠেকাতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। অর্থনৈতিকভাবেও বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছে তখনই এই পঁচাত্তরের আঘাত আসলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার যে উদ্যোগটা ছিল, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন হয়ে সব দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার জন্য সুনির্দিষ্ট কয়টা লক্ষ্য তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে অপপ্রচার চালানো শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, সেখানে নির্বাচনের জন্য যে ব্যবস্থাটা তিনি নিয়েছিলেন সেখানে যার যার নির্বাচন সে করতে পারবে। নির্বাচনের সব খরচ প্রত্যেকটা প্রার্থীর জন্য দেয়া হবে রাষ্ট্রের জন্য। সেখানে একটা সিটে যারা প্রার্থী হবে তাদের সবার নাম একটা পোস্টারে দেয়া হবে। এই পোস্টার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছাপানো হবে। জনগণের সঙ্গে যার সম্পৃক্ততা আছে, জনগণের সঙ্গে যারা যোগাযোগ করবে এই যোগাযোগের মধ্য দিয়ে জনগণ যাকে পছন্দ করবে তাকে ভোট দেবে। অর্থাৎ ভোটের অধিকার, এই অধিকারটা তৃণমূল মানুষের কাছে যাতে পৌঁছায় এবং তারা যেন স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারে সেই সুযোগটা তিনি সৃষ্টি করে দিতে চেয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যে উদ্যোগটা নিয়েছিলেন, সেটা যদি কার্যকর করা যেত তাহলে বাংলাদেশে আর জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে কেউ খেলতে পারতো না। জনগণ তার মন মতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারত।
তিনি বলেন, জাতির পিতার কথা ছিল একটা বিপ্লবের পর সমাজে একটা বিবর্তন আসে। সেই বিবর্তনের ফলে এটা সব দেশেই হয়, যে দেশ যেখানেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে বা বিপ্লব করেছে বা পরিবর্তন এনেছে তার পরই কিছু লোক আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়। অথবা বলপ্রয়োগ করে। সেটা থেকে সমাজে স্থান না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি তা করেছিলেন।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে পদক বিতরণ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৯ বিজয়ী ১২ জন ব্যক্তির হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব এগ্রিকালচারের (বিআইএনএ) পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক পদক গ্রহণ করেন।
এইউএ/এমআরএম/এমএস