‘পেটে ভাত নাই আমাকে বাঁচান’
খুলনা পিটিআই স্কুলের শিশু শ্রেণিতে পড়ে অন্তরা। তার মা রেবা খাতুনের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। মা ঢাকায় আসায় স্কুল ছেড়ে তাকেও আসতে হয়েছে ইটপাথরের শহরে। ১৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত খুলনা আইডিয়াল কলেজে গত চার বছর ধরে চাকরি করছেন রেবা খাতুন। কিন্তু পাননি একটি টাকাও। বিনা বেতনে চাকরির কারণে তিন মেয়েকে নিয়ে বিপাকে তার পরিবার। মায়ের কলেজের এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে সড়কে দাঁড়িয়েছেন শিশু অন্তরাও।
রাজধানীর হাইকোর্ট ও প্রেস ক্লাব সংলগ্ন কদম ফোয়ারার সামনে আন্দোলনের অংশ হিসেবে অবস্থান করছেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। সেখানে রেবা খাতুনের সঙ্গে অংশ নিয়েছে শিশু অন্তরাও।
শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে ‘পেটে ভাত নেই আমাকে বাঁচান’লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। পাশেই একইভাবে দাঁড়িয়ে রাজবাড়ীর পাংশার সেনগ্রাম পাড়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোমেনা খাতুনের মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা জিম। তার হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘আামর মায়ের বেতন চাই’।
কথা হয় শিশু জিমের সঙ্গে। জিম বলে, ‘আব্বু কোম্পানিতে চাকরি করে। আম্মুও চাকরি করে কিন্তু বেতন পায় না, ফ্রি। খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের ভাইবোনের পড়াশুনা ও খাওয়ায় কষ্ট হচ্ছে। আম্মুর মাদ্রাসার চাকরিতে বেতন নেই। বেতন হলে খেয়ে-পরে ভালো থাকতাম। আম্মুর সঙ্গে এখানে এসেছি। সবাই বেতন চায়, কিন্তু কেউ দেয় না। আমিও আম্মুর বেতন চাই।’
জিমের মা মোমেনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান ১৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। তখন থেকে আমিও চাকরি করছি। কিন্তু বেতন তো দূরের কথা আমার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিই হয়নি। এর আগে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকায় এসেছিলাম। প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার কপাল খুলবে। সন্তানদের এবার ভালো খাবার, পোশাক কিনে দিতে পারব। সেটা আর হলো না। বাংলাদেশই বুঝি পৃথিবীর বিরল দেশ, যেখানে চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই।’
‘আমাদের দাবি তো যৌক্তিক। তবে কেন আমাদের সঙ্গে এমন খেলা চলছে? অর্থমন্ত্রী বলেন এক কথা, শিক্ষামন্ত্রী বলেন আরেক কথা। আবার প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব এসে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দাবি মেনেছেন, সহসা বেতন হবে। এ সহসা আর শেষ হচ্ছে না। এবার আর কোনো অনিশ্চয়তা নয়। এমপিওভুক্তির ঘোষণা নিয়েই বাড়ি ফিরতে চাই,’ বলেন মোমেনা খাতুন।
খুলনা সদরের নিরালা এলাকার রেবা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্যদের মতো আমারও একই অবস্থা। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কেউ ডাক্তার হচ্ছে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তাদের যারা প্রাথমিক ভিত্তি আমরা গড়ে দিলাম সেই শিক্ষকরা বেতন পাই না। খেয়ে না খেয়ে পাঠদান করে আসলাম। আর কত? পেটে ভাত না গেলে আসলে কিছুই ভালো থাকে না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে।’
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, কদম ফোয়ারা থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মূল গেট পর্যন্ত অবস্থান করছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা। সড়কে পলিথিন ও কাগজ বিছিয়ে কেউ বসে, কেউবা শুয়ে আছেন। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, শেখ হাসিনার বাংলায়, উন্নয়নের বাংলায়, শিক্ষক কেন রাস্তায়, স্লোগান দিতেও দেখা যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের।
নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী এ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিকভাবে লিখিত কোনো নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত তাদের অবস্থান দিন-রাত সমানতালে চলবে।
শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন জানায়, গতকাল রাত সাড়ে তিনটার দিকে বরগুনার তালতলী উপজেলার শিক্ষক শৈলেন চন্দ্র মজুমদার (৫০) অবস্থানস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি এখন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন।
নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে আবারও রাজপথে নেমেছি। নির্ধারিত কর্মসূচি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের উদ্দেশে আমাদের পথযাত্রা পুলিশ আটকে দিলে আমরা প্রেস ক্লাব সংলগ্ন কদম ফোয়ারায় অবস্থায় করছি। এখানেই রাত্রীযাপন করেছি কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।’
অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায় বলেন, ‘আমাদের দাবি কি অন্যায্য? যদি তাই মনে হয় তাহলে বলে দিন। আমরা আর ক্লাসে ফিরব না। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় কিন্তু তা পালন করা হয় না। এক বছর পার হলেও আজও আমাদের দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণেই আমরা আবারও সমবেত হয়েছি।’
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা তুলে ধরতে চাই। তিনি আমাদের যে নির্দেশনা দেবেন, তাই মেনে নেয়া হবে।’
সারাদেশের ৫ হাজার ২৪২টি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী প্রেস ক্লাবের সামনে উপস্থিত হয়েছেন বলে দাবি করেন বিনয় ভূষণ রায়।
জেইউ/এনডিএস/পিআর