কেউই ধোয়া তুলসী পাতা নই : দুদক চেয়ারম্যান
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন এ সমাজের বাইরের কোনো অংশ নয়। গত তিন বছরে সরকার রাজনৈতিক দল কিংবা কথিত ক্ষমতাবানরা কেউ দুদককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। আমরা নিজেরা নিজেদের প্রভাবিত ভাবতে পারি, বাস্তবতা হচ্ছে কেউ আমাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করারও সাহস পাননি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ-ই ধোয়া তুলসী পাতা নই। তবে আমরা আমাদের ভুলটা স্বীকার করি, দুর্বলতা অস্বীকার করি না।’
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে সোমবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কমিশনের কৌশলপত্র-২০১৯ এর ওপর এক মতবিনিময় সভায় এ সব কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যান।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘অনেকেই বলেন মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যর্থতার জন্য দুদকের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনার একক দায়িত্ব দুদকের হাতে না রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ একাধিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুদক কেবল ঘুষ ও দুর্নীতিসম্পৃক্ত মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিংয়ের তদন্ত অন্যান্য সংস্থাসমূহের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের সিংহ ভাগ অর্থ পাচার হয়ে থাকে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে। আমরা রাজস্ব বোর্ডের কাছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের তালিকা চেয়েছি। প্রয়োজনে তালিকা ধরে আইনি ব্যস্থা নেয়া হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি একক সেক্টর হিসেবে সর্বোচ্চ মামলা এবং গ্রেফতার হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে। কমপক্ষে ১২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, জিএমসহ উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার সরকারের সচিব, যুগ্ম-সচিব, মহাপরিচালক পদমর্যাদার কমকর্তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা কৌশলগত কারণেই গ্রেফতার কম করছি।’
তিনি বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের ৫৬টি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আরও মামলা হতে পারে। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী যারা আসামি তারাও দ্রুত মামলার চার্জশিট চান। আমরা চেষ্টা করছি, তবে ব্যাংকের টাকাটা কিন্তু জনগণের। জনগণের টাকা ব্যাংকে ফিরে আসুক এটা কিন্ত জনগণ চায়। আপনারা জেনে খুশি হবেন, বেসিক ব্যাংকের প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা ব্যাংকে নগদ জমা হয়েছে। কমিশনের মামলার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে চুরি হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। আমরা অপরাধীদের পিছনে নিরবচ্ছিন্নভাবে আইনি অভিযান অব্যাহত রাখব। কাউকেই ছাড় দেব না।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘কমিশন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। কারণ এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গীকার আমাদের কাছে এসেছে। দেশের সরকার প্রধান বলেছেন, দুর্নীতি সমস্য, এর লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং একে দমন করতে হবে। আশা করি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হব।’
মতবিনমিয় সভায় সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মো. জমির বলেন, ‘বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় দুদকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় না।’
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুদকের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার পরিবশে সৃষ্টি করতে হবে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্র এখন পয়সা উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার মানের চরম অবনতি ঘটছে। যদি সক্ষম এবং দক্ষ শ্রমশক্তি না থাকে তাহলে এ দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার বিনিয়োগ আসবে না।’
বাংলাদেশকে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি স্কুল-কলেজে দুদকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের কমিশনের অর্থ চিকিৎসকদের পকেটে যাচ্ছে। এখানে স্যাডো এরিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দুদকের এদিকেও নজর দেয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘কমিশনের মিশনে দুর্নীতির গতি প্রকৃতি নির্ণয় থাকা উচিত। কাজের মধ্যে স্বচ্ছতার দৃশ্যমান মানদণ্ড থাকবে। স্বচ্ছতা আপেক্ষিক। তাই এর একটি মানদণ্ড থাকা উচিত। কমিশনের প্রতি মানুষের ভয় ও শ্রদ্ধা থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ কিছুটা সহজ হবে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি দমনকে আইনি প্রক্রিয়ায় না দেখে, এটিকে উন্নয়নের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। দুর্নীতি দমন করা না গেলে ২০৪১ সালের উন্নত দেশ বিনির্মাণ কঠিন হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী কোচিং বাণিজ্য বন্ধে দুদকের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে দুদকের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুদকের উচিত মেগাখাতের দুর্নীতি দমনে অধিকতর মনোনিবেশ করা।’ দুদকের মতো সার্বিকভাবে সরকারের একটি কৌশলপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করেন তিনি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ বলেন, ‘দুদকের প্রতি মানুষের ক্ষোভ কিংবা হতাশা থাকতেই পারে। কারণ আমরা অতীতে রাষ্ট্রের মধ্যে ছিলাম না। রাষ্ট্র কী জানতাম না, সিটি কী জানতাম না। সবই আমাদের কাছে নতুন । তাই রাতারাতি সবকিছু আশা করলে হতাশ হতেই হবে। তবে আশার কথা রাষ্ট্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হচ্ছে। রাষ্ট্র আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংযত হচ্ছে।’
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচিত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা মুক্ত থাকলে দুর্নীতি দমন হবে অবাস্তব চেষ্টা।’
সাবেক মন্ত্রী মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘রাজনৈতিক দুর্নীতি দমনে কমিশনকে আরও কাজ করতে হবে। ক্ষমতা এবং শক্তির উৎসেই আঘাত করতে হবে।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বড় দুর্নীতি আগে ধরতে হবে।’
মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ‘দুর্নীতি একটি খারাপ সংস্কৃতি । শিক্ষা-স্বাস্থ্যে দুদক হস্তক্ষেপ করলে সমস্যা কোথায়। রাজনৈতিক চিন্তা মাথায় না রেখে সমাজের কথা বিবেচনা করে কাজ করতে পারলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন- দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির, কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন প্রমুখ।
এমইউ/এনডিএস/জেআইএম