প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় অগ্নিকাণ্ড
‘রাত ১০টা ২৮/২৯ মিনিটে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই সময় এইখানে প্রচুর যানজট ছিল। ওই যে ওয়ালে রক্ত দেখা যাচ্ছে (মসজিদের দেয়ালে রক্তের দাগ বিকেল পর্যন্ত দেখা যায়), ওই রক্তগুলা। লাশের বডি-টডি, হাত-পাও ওইখানে ছিটকে পড়েছে।’
রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের এভাবেই বর্ণনা দেন সেখানকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট অলক কুমার।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনায় ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আরও ২৫ জনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।
রাস্তায় রিকশা, গাড়ি, পিকআপ, মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের যানবাহনের পোড়া অংশ ঘটনাস্থলে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দেয়ালের বিভিন্ন অংশও পড়েছিল রাস্তায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীদের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদক জানার চেষ্টা করে কীভাবে আগুন লেগেছে এবং কেমন ছিল তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতি।
মো. জয়নাল আবেদিন চা খাওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন অ্যাডভোকেট অলক কুমারকে। কিন্তু অলক কুমার এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে কয়েক মিনিটের দূরত্বে গণি মিয়ার ঘাটে যান। যখন তিনি বন্ধুর সঙ্গে চা খাওয়ার জন্য ফিরছিলেন, রাস্তার কিছুটা এগিয়ে যেতেই বিকট শব্দ শোনেন। শব্দের পর বন্ধুকে আর ফোনে পাননি।
অলক কুমার জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি পিকআপ ভ্যান গ্যাসের সিলিন্ডার ডেলিভারি দেয়ার জন্য হোটেলে এসেছিল। ডেলিভারি দেয়ার সময় একটা সিলিন্ডার পিছলে পড়ে গিয়েছিল পিকআপ ভ্যান থেকে। পরে ওই বোতলটা ব্লাস্ট (বিস্ফোরণ) হয়ে যায়। এরপর ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে আগুনটা ছড়িয়ে যায়। একদম পুরো ওপরে উঠে যায়।’
তবে আগুন লাগার বিষয়ে অনেকে অন্য কারণের কথাও বলেছেন। একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, সিলিন্ডার থাকা পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে সিএনজির সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে একটি সিলিন্ডার পড়ে যায় এবং আগুন ধরে। এই আগুন হোটেলে থাকা সিলিন্ডারেও লেগে যায়। এরপর সেই আগুন বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে লাগে এবং বিস্ফোরণ ঘটে।
আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা মিনু। এই বৃদ্ধা স্থানীয় ভাষায় জাগো নিউজকে জানান, বিকট শব্দের পর আগুন দেখে তিনি ঘটনাস্থলের ছুটে আসেন। যখন চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডে আসেন, তখন দেখেন পোড়া শরীর নিয়ে একজন দৌড়াচ্ছেন। তার পুরো শরীর ছিল ঝলসানো। সেই সময় শরীরের বীভৎস দৃশ্য যাতে তিনি বেশিক্ষণ না দেখেন, সেজন্য বৃদ্ধার সঙ্গে থাকা অন্যজন কাপড় দিয়ে তার চোখ ঢেকে দেন। এরপর মিনু দেখেন আরও দুইজন পোড়া শরীর নিয়ে আসছে। তবে তাদেরকে কয়েকজন ধরে নিয়ে আসছিলেন।
এই আগুনে মাসুদ রানা (৩৫) ও মাহবুর রহমান রাজু (২৮) নামে দুই ছেলে মারা যায় মো. শাহবুল্লাহর। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘দোকান থেকে বেরিয়ে অল্প একটু আসতেই শব্দ শুনেছি। আমি আর ওইদিকে যাইতে পারি নাই। পুরা রাস্তায় আগুন। ওইখান থেকে কেউ বের হইতে পারে নাই।’
গলির মাথাতেই চায়ের দোকান মো. নাজমুল আলমের। যখন আগুন লাগে, তখন তার দোকান খোলা ছিল। তিনি বলেন, ‘বিকট শব্দ হইল। শব্দের পরেই আগুন আর আগুন। আগুন লাগার পর থেকেই গুলির মতো আওয়াজ। ঠাস ঠাস ঠাস শব্দ অইতাছিল। আগুন লাগার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত এই ঠাস ঠাস আওয়াজ হইছে।’
নাজমুল আলম জানান, যে বাসায় আগুন লাগে, সেই বাসার গ্রাউন্ডফ্লোরে বিভিন্ন স্প্রের গোডাউন ছিল। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার লগে লগে দোকান বন্ধ কইরা দিছি। তাপে থাকতে পারি নাই। আমার বয়সে এই ধরনের আগুন দেহি নাই।’
চকবাজারের চুড়িহাট্টা বাজারের মোড়ের বাড়িটিই ওয়াহিদ ম্যানশন। ভবনটির চারতলায় পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে থাকতেন বুলবুল আহমেদ। যখন আগুন লাগে তখন পরিবারের চার সদস্য বাসায়। যখন তাদেরকে নিচে নামিয়ে আনা হয় তখন তিনজনই ছিল অচেতন। তবে তাদের পরিবারের কেউ বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হননি।
বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘রাস্তার মানুষ বেশি মারা গেছে। আমাদের কেউ আহত হয় নাই। পাঁচ বছর ধরে আমি এই বাসায় থাকতাম। কেমিক্যালের গোডাউন যে ছিল, সেটা তো আমরা জানতাম না। ওইটা তো আন্ডারগ্রাউন্ডে। সবসময় তালাবন্ধ থাকত। আগুন লাগার পরেই জানতে পারছি বিষয়টা।’
বাড়ি মালিকের নাম হাসান বলে জানান বুলবুল। বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘গোডাউন ছিল অন্য লোকের। উনি ভাড়া দিতেন। বাড়িওয়ালা হাসান ভাড়া দিছিল।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগুনে আক্রান্তরা প্রাথমিক চিকিৎসাও পাননি। এ প্রতিবেদককে স্থানীয়রা জানান, চকবাজার এলাকায় কেবল একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে আগুন লেগেছে, সেখান থেকে দুই মিনিটের হাঁটার পথ চকবাজার হাসপাতাল। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এই হাসপাতালও বন্ধ করে দেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, এখানে কেউ প্রাথমিক সেবাও নিতে আসেনি। হাসপাতালের রিসিপশন থেকে জানানো হয়, বিদ্যুৎ না থাকায় এবং হাসপাতালেও আগুন লেগে যেতে পারে, এই ভয়ে তারা হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছিল।
পিডি/এসআর/পিআর