যদি মন্ত্রী-বড় কর্তার বিরুদ্ধে সত্য সংবাদ হয় প্রকাশিত হবে, তবে...
>> যে মাইকিং দিয়ে আমার শুরু সে মাইকিং এখনো চলছে
>> আমি সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেছি
>> অনলাইনের প্রয়োজন আছে, অনেক অনলাইন ভালো করছে
>> দুই ঘণ্টা পরপর অনলাইনে খবর দেখি
>> সকালে ৪০-৪৫ মিনিট পত্রিকা না পড়লে মনে হয় কিছু পড়িনি
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ। অবশ্যই সমালোচনা হবে। সমালোচনা যে কোনো কিছুর পথচলাকে শাণিত করে। বিতর্ক ছাড়া ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সমাজ, রাষ্ট্র, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা।’
রোববার (২৭ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে সংগঠনটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই যে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে। যদি কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সত্য সংবাদ হয়, সেটি অবশ্যই পরিবেশিত হবে। যদি রাষ্ট্রের কোনো বড় কর্তার বিরুদ্ধে সত্য সংবাদ হয়, সেটিও অবশ্যই পরিবেশিত হবে। তবে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনে যদি বীভৎস দৃশ্য দেখানো হয়, সেই বীভৎস দৃশ্য বাস্তব, কিন্তু সেটির কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কি না- সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, সমালোচনা- এসব যদি সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে একযোগে করি, তাহলে দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ উপকৃত হবে।’
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু আমি সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেছি। যখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন ছাত্রলীগের প্রেস রিলিজ লিখে পত্রিকা অফিসগুলোতে দিয়ে আসতাম। এ কাজগুলো আমি বহুদিন করেছি, যারা পুরনো সাংবাদিক তারা আমাকে সেই ভূমিকায় দেখেছেন।’
নিজের কথা বলতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনোদিন ভাবিনি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেবেন। আমি যখন ছাত্ররাজনীতি শুরু করি, চট্টগ্রাম নগরে আওয়ামী লীগের কোনো জনসভা হলে সেটার মাইকিং আমি করেছি। পরে প্রধানমন্ত্রী আমাকে দলের প্রচার সম্পাদক, মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে দলের মাইকটি ধরিয়ে দিয়েছেন। এবার তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের মাইকটিও ধরিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ যে মাইকিং দিয়ে শুরু সে মাইকিং এখনো চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ৬ বছর ধরে আমি আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এই সময় থেকে আমার প্রাত্যাহিক উঠাবসা, ঘর-সংসার সাংবাদিকদের সঙ্গে। একেবারে প্রতিদিনই সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। প্রধানমন্ত্রী হয়ত সে কারণে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। এটি সরকার এবং সরকারি দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
সাংবাদিক সমাজের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের কাজ আমি প্রথম দিন থেকেই শুরু করেছি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের বক্তব্য অনুযায়ী কোনো তথ্যমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রেস ক্লাবে যাননি। আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রেস ক্লাব সভাপতি, সম্পাদককে বলে সেখানে গিয়েছি। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে বসেছি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে বসেছি। সচিবালয় রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে বসেছি। আজকে আমার সৌভাগ্য হলো, আমার নিজের শহর, নিজের বাড়ির সাংবাদিক ভাই-বোনদের মিলনমেলায় আসতে পেরেছি।’
‘নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটি পুনঃগঠন করতে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, শুধু তথ্য মন্ত্রণালয়ই প্রথম বৈঠকে প্রস্তাব রেখেছে। অন্যান্য প্রস্তাব যেগুলো প্রথম বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে সেগুলো আইন-অধ্যাদেশ। সেগুলো এমনিতেই করতে হত। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে একমাত্র প্রস্তাব নিয়ে গেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের জন্য আগের মন্ত্রিসভা কমিটি ছিল পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট। এবার দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যকে প্রধান করে সাতসদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে,’- বলেন তথ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্র মালিকদের দুটি সংগঠন আছে। একটির সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। এ ছাড়া সাংবাদিকদের সংগঠন আছে। সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করা হবে। সেজন্য আমরা রাতদিন কাজ করছি। ওয়েজবোর্ড হয়েছিল মূলত সংবাদপত্রের জন্য। ৭ম, ৮ম ওয়েজবোর্ড সংবাদপত্র নিয়ে কাজ করেছে। ৯ম ওয়েজবোর্ডে টেলিভিশনের বিষয়টি পরামর্শ আকারে দেয়া আছে। তবে সম্প্রচার নীতিমালা হলে টেলিভিশনের পাশাপাশি দেশে অনেক এফএম রেডিও আছে। দুই-একটির শ্রোতার সংখ্যা অনেক, টেলিভিশনের দর্শকের চেয়ে কম নয়। সুতরাং তাদেরও সম্প্রচার নীতিমালার আওতায় আনার বিষয়টি আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।’
অনলাইন মিডিয়া পৃথিবীর বাস্তবতা উল্লেখ করে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমি প্রতি এক ঘণ্টায় না হলেও দুই ঘণ্টা পরপর অনলাইনে খবর দেখি। অনেক আগে থেকেই দেখি। আমি এখানে বসে আছি, এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ঘণ্টা আগে চলে গেছে। অনেক অনলাইনও সেটি নিউজ করে ফেলেছে। পত্রিকা তো আগামীকাল ছাপাবে। এখন নতুন প্রজন্ম দেখা যায় যে, তারা অনেকে পত্রিকা পড়ে না। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন। সকাল বেলা মিনিমাম ৪০-৪৫ মিনিট বা এক ঘণ্টা পত্রিকা না পড়লে মনে হয় আমি কিছু পড়িনি। দিনটাই শুরু হয়নি। এটি হচ্ছে অভ্যাসের ব্যাপার। কিন্তু নতুন প্রজন্ম আমাদের মতো পত্রিকা পড়ে না। এটা বাস্তবতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইনের প্রয়োজন আছে। অনেক অনলাইন অত্যন্ত ভালো কাজ করছে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করছে। তাদের অভিনন্দন জানাই, সাধুবাদ জানাই। কিছু অনলাইন আছে, যাদের সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মান রক্ষিত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে প্রপাগান্ডার কাজে ব্যবহার হয়। তাই এগুলোকে একটা নিয়ম-নীতির মধ্যে আনার জন্য আমরা কাজ করছি। সম্প্রচার নীতিমালা পাস হলে অনলাইনগুলো নিবন্ধন করা হবে। ইতোমধ্যে অনেক অনলাইনের তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত করা হয়েছে। বাকি কাজ করতে আরও সময় লাগবে।’
সাংবাদিকদের আবাসনের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সাংবাদিকদের আবাসনের কথা বলা আছে। আমরা ইশতেহার বাস্তবায়ন করব। এটি কীভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি কয়েকদিনের মধ্যে বসব। এখন তো জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। ঢাকায় আমরা ফ্ল্যাটের কথা চিন্তা-ভাবনা করছি।
চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেলসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আধুনিক করা, মিরসরাই পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ, গুনধুম পর্যন্ত রেললাইন হবে। চট্টগ্রামে আজ অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেটা আছে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হবে। আগামী পহেলা বৈশাখ থেকে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ৯ ঘণ্টা সম্প্রচার শুরু হবে। কয়েক মাস পর ১২ ঘণ্টায় উন্নীত করা হবে। নতুন বছরের শুরুতে বিটিভির দ্বিতীয় টেরিস্টরিয়াল চ্যানেল হিসেবে দেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এর আগে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান, সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী আবুল মনসুর, সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমউদ্দিন শ্যামল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আবু আজাদ/জেডএ/পিআর