২০১৮ সালে ১০১১ শিশু নির্যাতনের শিকার
দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালে সারাদেশে ১ হাজার ১১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে বিভিন্ন কারণে মৃত্যু হয়েছে ২৮৩ জনের। আত্মহত্যা করে ১০৮ জন। এ ছাড়া রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার ২৮ জন এবং যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয় ৪৪৪ জন শিশু। তবে এ বছরে নারী ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার কমে ৭৩২ জনের সংখ্যায় নেমেছে। যা ২০১৭ সালে ছিল ৮১৮ জন।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৮ : আসকের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংগঠনের তদন্ত কর্মকর্তা আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। তিনি জানান, বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৮ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। বছরজুড়ে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৪৬৬ জন। এর মধ্যে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে ২৯২ জন নিহত হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, নিখোঁজ ও গুমের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেলেও তাদের অধিকাংশ বিভিন্ন মামলায় আটক আছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ২০১৮ সালে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। তবে ২০১৭ সালে নারী নির্যাতন ও গণধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন, ২০১৬ সালে ৭২৪ জন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে শিশু নির্যাতন ও হত্যা বেড়েছে। এ বছর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় মোট ১ হাজার ১১ জন শিশু। তার মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে মৃত্যু, ধর্ষণ চেষ্টার ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ২৮৩ জন নিহত হয়েছে। আত্মহত্যা করে ১০৮ জন, রহস্যজনক মৃত্যু ২৮ জনের এবং যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৪ জন শিশু।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরে আসক বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭০টি সহিংসতার ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯ জন ও বিএনপির ৪ জন রয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ৭০১টি সহিংতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬৭ জন নিহত হয়েছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও তথ্য ও যোগাযোগ আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সমরূপ আটটি ধারা সন্নিবেশিত হয়েছে বলে বলছে আইন ও সালিশকেন্দ্র। সংস্থাটির মতে, এসব ধারায় মত প্রকাশের অধিকারকে বাধ্যগ্রস্ত করার আশঙ্কা রয়েছে।
উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে আসকের পর্যবেক্ষণে। আবু আহমেদ ফজুল কবির আরও জানান, ২০১৮ সালে বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৭৩ জন। যার মধ্যে ১১৬ জন নারী। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারীসহ খুন হয়েছে ১২ জন। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাড়াছা যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়ছেন ১৯৫ জন। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৮৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন।
অন্যদিকে পরিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪০৯ জন। এ ছাড়া ৫৮ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ নারী, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৬ নারী এবং নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে মারা যান ১৮ জন। অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন ২২ জন। এর মধ্যে একজন মারা যান।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গেল বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে ৯৭টি প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ২৯টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে একজন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন।
সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্রও স্থান পেয়েছে আসকের পর্যবেক্ষণে। এতে বলা হয়, গেল বছরে হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৭ জন সাংবাদিক। এছাড়া দুর্বৃত্তদের দ্বারা ৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়ছেন।
এ বছর ভারতীয় সীমান্তক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ৮ জন ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৬ জনসহ মোট ১৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি সুপারিশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সংস্থাটি বলছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও গুপ্তহত্যার বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন, গুম/নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করাসহ গুম-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স-এ বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষর, নারী ও শিশুর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ, মত প্রকাশের অধিকার কার্যকর ভূমিকার গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আসকের পরিচালক সিফা হাফিজ, সিনিয়র উপ-পরিচালক নিনা গোস্বামী, সদস্য তাহমিনা রহমান প্রমুখ।
এমএইচএম/এসআর/এমকেএইচ