ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা নারীদের গল্পগাথা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১০:০৩ পিএম, ০১ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি। উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে তারামন বিবির যুদ্ধ জয়ের গল্পগাঁথা আজও শিহরিত করে মুক্তিকামী মানুষের।

যুদ্ধে জয় এসেছে, অথচ তাতে নারীর অবদান নেই, বিশ্ব ইতিহাসের তা বিরল। ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও। নারী সমরে ছিল, ছিল নেপথ্যের শক্তি-সাহসে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ঈর্ষণীয়, যা ন্যয়ের পক্ষে যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অদম্য সাহস আর উদ্দীপনা নিয়ে তারা বিজয় ছিনিয়ে আনেন। বিশেষ করে যুদ্ধে গেরিলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা সংগ্রামী নারী সমাজে আজও প্রেরণার উৎস।

মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা; যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে শতাধিক নারীকে নির্বাচিত করা হয়। প্রথম এদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সর্ম্পকে ধারণা দেয়া হয় এবং তাদের মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

পূর্বাঞ্চলীয় হাই কমান্ড শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আ স ম আব্দুর রব কিশোর তরুণ নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন লেম্বুচোরা ক্যাম্প, আগারতলায়।

মুক্তিযুদ্ধের আরেক মহিয়সী নারী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সংগ্রামী যোদ্ধা নারীদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে নারীরা অস্ত্র চালনা শিখতো।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুণী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। এ ছাড়াও সিভিল ডিফেন্স ও নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সেখানে।

মুক্তিযুদ্ধে নারী শক্তির অন্যতম নাম তারামন বিবি বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাঁধুনী হিসেবে যোগ দেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেন এ গেরিলা। একের পর এক অ্যাসাইনমেন্ট সে পাকিস্তানী সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠী ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাক সেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকসেনা শিবিরে হামলা চালায়।

এ ছাড়া ওই রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙালি পরিবারকে পাকবাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার অ্যাসাইনমেন্টও অংশ নেয়।

একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। একসময় পাক সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। ৭/৮ দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।

বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বহিনীতে করুণা বেগম অন্য মহিলাযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এ বাহিনীর অধীনে ৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ছদ্মবেশে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন। এ ছাড়াও স্টেনগান রাইফেল চালানো এবং যেকোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সর্ম্পকে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন।

পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাইফেল, বন্দুক, এসএমজি, এসএলআর সবকিছু চালানোতেই সমান পারদর্শী ছিলেন আলেয়া। শত্রু পক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবেলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে ছুটতেন তিনি। একাধিক সম্মুখযুদ্ধে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন।

পিরোজপুর জেলার অপারেশন স্বরূপকাঠী বাহিনীর অকুতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কনা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোর্ড। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপনায় মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে অখ্যাত গ্রামের নারীরা হয়ে উঠেছিল এক একজন দুর্র্ধষ গেরিলা। বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেয়ার জন্য নারীদের সংগ্রহ করে আনতো। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ নারীকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল।

বিশ্লেষক এবং ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এখনও পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন হয়নি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শত শত নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি এবং গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিলেও এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছে মাত্র ২০৯ নারী।

এএসএস/এনডিএস/পিআর

আরও পড়ুন