বৃদ্ধাশ্রমে অবহেলার জীবন ফুরাল আত্মহননে
মানুষ কখন মৃত্যুকে জীবনের চাইতে শ্রেয় মনে করে? এই প্রশ্নটা সবার হলেও উত্তরটা আমাদের সবার জানা নেই। ব্যক্তি তার মৌলিক চাহিদাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পরিচয়টা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, পরিবারের মাঝে বাঁচতে চায়। সেই পরিচয়টাই যখন কেউ হারিয়ে বসে তখন তার কাছে জীবন-মৃত্যুর ফাঁরাক ঘুচে যায়। আমাদের অবহেলাই সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়। যেমনটা ঘটেছে রাউজানের বয়োজ্যেষ্ঠ আবুল হাসেমের (৫০) ক্ষেত্রে।
আমেনা-বশর বৃদ্ধাশ্রমের সেবক প্রদীপ দত্ত জাগো নিউজকে জানান, আশ্রমের যে কক্ষটিতে আবুল হাসেম থাকতেন সেই কক্ষে আরও তিন বৃদ্ধ থাকেন। তাদের মধ্যে একজন পক্ষাঘাত ও বাকপ্রতিবন্ধী রোগী। মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) রাত আটটার দিকে পক্ষাঘাত বৃদ্ধ বিছানায় থাকলেও অপর দু’জনের মধ্যে একজন এবাদতখানায় নামাজে আরেকজন রাতের খাবার খেতে ওই সময় ডাইনিং কক্ষে ছিলেন। এই সময় শোয়ার খাটের পাশে থাকা জানালার রডের সঙ্গে পায়ের ব্যান্ডেজের কাপড় খুলে গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন বৃদ্ধ আবুল হাসেম।
তিনি বলেন, ‘রুমে থাকা দু’জনের জন্য খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে দেখি জানালার সঙ্গে ফাঁস লাগানো অবস্থায় বৃদ্ধ আবুল হাসেমের দেহ খাটের উপর কাত হয়ে আছে। তিনি শেষ দিকে বারবার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তার শেষ চাওয়াটা পূর্ণ হয়নি। এ ছাড়া পায়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলেন না মানুষটা।’
আমেনা-বশর বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তারা জানান, ক’মাস ধরে পায়ের সমস্যায় ভুগছিলেন নোয়াপাড়া আমেনা-বশর বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা আবুল হাসেম। যা মাস খানেক আগে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। পরে বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার পায়ের অবস্থা খারাপ দেখে বাম পা’টি কেটে ফেলেন। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন এক বোনও। গত প্রায় দু’সপ্তাহ আগে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে হাসেম আবার বৃদ্ধাশ্রমে ফিরলেও তাকে একটিবারের জন্যও কেউ বাড়ি নিতে আসেনি। যদিও উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের ফকিরটিলা গ্রামে নিজের স্ত্রী-সন্তান রয়েছেন। তার দুই ছেলে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। অপর এক ছেলে স্থানীয় মাদরাসায় পড়ে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, হাসপাতাল থেকে ফিরে বেশ কয়েকবার বাড়িতে ফেরার কথা জানিয়েছিলেন আবুল হাসেম। পরে চিকিৎসাকালীন সময় পাশে থাকা বোনকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু পরে এসে নিয়ে যাওয়ার আশা দিয়ে তার সেই বোনও আর ফিরে আসেননি! এদিকে তার পায়ের ব্যথাও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছিল। প্রায় সময় আবুল হাসেম ব্যথা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতেন।
হলদিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে জানান, ‘গত কয়েক বছর আগে আবুল হাসেমের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পারিবারিক বিষয়ে ঝামেলা হয়। সে সময় আবুল হাসেম নিজের বাড়ি ভিটা স্থানীয় একজনের কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন। পরে নিজেই গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। পরিবারের কেউ খবর না নিলেও মাঝে মধ্যে তার এক বোন বৃদ্ধাশ্রমে আবুল হাসেমকে দেখতে যেতেন। তার বাম পা কেটে ফেলার পর থেকে ডান পা-ও ধীরে ধীরে অচল হয়ে পরে। রাত-দিন পায়ের যন্ত্রণায় চিৎকার ও কান্নাকাটি করতেন তিনি। গত সোমবার তার বোন দেখতে এলে তিনি তাদের সঙ্গে বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা আগামী বৃহস্পতিবার এসে তাকে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ চার বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থান করলেও তার বোন ছাড়া স্ত্রী-পুত্র কেউ তাকে দেখতে আসেনি।’
নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আমেনা-বশর বৃদ্ধাশ্রমের সংশ্লিষ্ট দিদারুল আলম জানান, ‘নিহতের মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির স্বজনরা লাশ নিতে আসছেন বলে জানা গেছে। পরিবার যদি মরদেহ গ্রহণ না করেন সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা সম্পন্ন করে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থায় মরদেহ দাফন করা হবে।’
আবু আজাদ/এসএইচএস/পিআর